E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পরিবারে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ 

অর্থাভাবে ফিকে হয়ে আসছে অর্পিতার শিক্ষা জীবন 

২০২৫ আগস্ট ২৮ ১৮:১৩:১১
অর্থাভাবে ফিকে হয়ে আসছে অর্পিতার শিক্ষা জীবন 

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অর্পিতা পড়েছেন নিজ গ্রামে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শাহবাজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী কাশিপুর এ.সি. মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেই স্কুল থেকেই এসএসসিতে অংশ নিয়ে এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন অর্পিতা। বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের এই স্কুলে প্রায়ই হেঁটেই যাতায়াত করতে হতো তাকে।

শুরু থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিলো। স্বপ্ন দেখতেন বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়বেন, জানবেন মহাকাশের অজানা সব তথ্য। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব ফি, টিউশন, কোচিংসহ নানা ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নেই তার পরিবারের। তাই স্বপ্ন বদলাতে হয়। বিজ্ঞানের বদলে মানবিক বিভাগ বেছে নিয়েই মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করেন অর্পিতা।

পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ, ছিল বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার স্বপ্নও। কিন্তু অভাবের চাপে বই-খাতা কেনার টাকাটুকু জোগাড় করাও যেখানে কঠিন, সেখানে ব্যয়বহুল বিজ্ঞান বিভাগে পড়া যেন বিলাসিতা। বাধ্য হয়ে মানবিক বিভাগে পড়লেও নিজেকে দমিয়ে রাখেননি অর্পিতা বিশ্বাস। ফলাফল, এসএসসিতে জিপিএ-৫।

অর্পিতা নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের মেয়ে। তার বাবা অসীম কুমার বিশ্বাস কৃষিশ্রমিক। অন্যের জমিতে হালচাষ, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা— যা কাজ পান, তাই করেন। পারিশ্রমিক যা পান, তা দিয়ে তিন মেয়ে ও স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার চালানোই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে মেয়ের ভালোভাবে পড়াশোনার খরচ জোগানো প্রায় অসম্ভব।

অর্পিতা বলেন, ছোটবেলা থেকে মহাকাশ সম্পর্কে জানার ভীষণ আগ্রহ ছিল আমার। ইচ্ছা ছিল, তাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ব। কিন্তু আমাদের পরিবারটা খুবই অসচ্ছল। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়ার জন্য যে আর্থিক সামর্থ্য প্রয়োজন, সেটা আমাদের ছিল না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিই, মানবিকে পড়ব। সেখানেও সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

তিনি আরও বলেন, আমার স্বপ্ন এখন পড়াশোনাটা ঠিকঠাকভাবে চালিয়ে যাওয়া, সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ হওয়া। স্বপ্ন দেখি, একদিন বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের সেবা করব। বাবা-মা, শিক্ষকসহ যারা আমার জন্য কষ্ট করেছেন, তাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করব।

শুধু বইয়ের পেছনেই নয়, জীবনযুদ্ধের প্রতিটি ধাপেই লড়াই করতে হয়েছে তাকে। কখনো বই-খাতা কেনার টাকা ছিল না, কখনো স্কুলে যাতায়াতের। অর্থের অভাবে ঠিকমতো প্রাইভেট পড়তেও পারেননি। নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে করেছেন টিউশনি। তবু অর্পিতা ক্লাসে ছিলেন নিয়মিত, পরীক্ষায় ছিলেন এগিয়ে।

অর্পিতার বাবা অসীম বিশ্বাস বলেন, মেয়েটা আমার ছোটবেলা থেকেই খুব মনোযোগী। সব পরীক্ষায় ও ভালো ফল করিছে। ওরে কখনো পড়তে বলা লাগেনি। অভাবের সংসার হওয়ায় যে যত্ন নেওয়া দরকার, তা পারিনি। পড়াশোনার খরচ ঠিকমতো দিতে পারিনি। ও নিজেও প্রাইভেট পড়াইছে। কষ্ট করেই মেয়েটা আমার এ পর্যন্ত আইছে।

জিপিএ-৫ পাওয়ার পর পরিবারের মধ্যে খুশির আবহ। কিন্তু সামনে আরও কঠিন পথ। কলেজে ভর্তি হওয়া, ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাওয়া-সবই নির্ভর করছে অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর। স্থানীয়ভাবে কেউ এগিয়ে এলে কিংবা কোনো সংস্থা সহায়তার হাত বাড়ালে অর্পিতার স্বপ্ন আবার ডানা মেলতে পারে।

অর্পিতার মা সুমিতা বিশ্বাস বলেন, আমাগে তিনটা মেয়ে। অর্পিতা সবার বড়। মাইঝে মেয়েটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের একজন মাত্র আয় করে। তিনিও শারীরিকভাবে অসুস্থ। এহন অর্পিতার পড়াশোনা কীভাবে চলবে, সেই চিন্তায় দিন যায় আমাগে। এতো মেধাবী মেয়েটা আমার, টাকার অভাবে পড়াশোনা কি বন্ধ হয়ে যায়?

অর্পিতার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নীলিমা সুলতানা বলেন, ছোটবেলা থেকে অর্পিতা খুবই মেধাবী ছিল। সবসময় ভালো ফলাফল করেছে। পিএসসিতেও আমাদের বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ওর মতো মনোযোগী, ভদ্র আর আত্মনিবেদিত শিক্ষার্থী খুব কম দেখি। ওর সাফল্যে আমরা গর্বিত, কিন্তু একই সঙ্গে শঙ্কিতও। এই মেয়ের লেখাপড়া যদি অর্থের অভাবে থেমে যায়, তাহলে সেটা সমাজের জন্যও একটা বড় ক্ষতি হবে। এ জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন ওই শিক্ষক।

(আরএম/এসপি/আগস্ট ২৮, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

২৮ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test