E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সাতক্ষীরার কাশেমপুরে স্কুলছাত্র মুরছালিনের মৃত্যু

দাবিকৃত ৪০ লাখ টাকা না পেয়ে গ্রেপ্তারকৃতদের বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট, গৃহকর্তা বাড়িছাড়া

২০২৫ অক্টোবর ০৪ ১৭:২১:১৬
দাবিকৃত ৪০ লাখ টাকা না পেয়ে গ্রেপ্তারকৃতদের বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট, গৃহকর্তা বাড়িছাড়া

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামের চতুর্থ শ্রেণীর স্কুল ছাত্র মুরছালিনের পানিতে ডুবিয়ে হত্যার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো শিশু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মাহাফুজুর রহমান শাওন ও তার মা নাজমা আক্তার এক মাস কারাগারে রয়েছেন। মাহাফুজুর রহমান শাওনের বয়স জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী ১০ বছর আট মাস হলেও পরিকল্পিতভাবে তার বয়স মামলায় ১৯ বছর দেখানো হয়েছে। তবে মামলা না করে মীমাংসার শর্তে দাবিকৃত ৪০ লাখ টাকা বা বাইপাস সড়কের ৫ কাঠা জমি লিখে দিতে রাজী না হওয়ায় ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে আসামী শাওনের বাবার বাড়ি (মাহাফুজ ভিলা)। জীরনের নিরাপত্তার অভাবে একমাসেও বাড়িতে ফিরতে পারেননি শাওনের বাবা আইনজীবী সহকারি আবু সাঈদ।

সরেজমিনে শনিবার সকালে কাশেমপুর পশ্চিমপাড়ায় (সরদারপাড়া) যেয়ে দেখা গেছে, আবু সাঈদের বাড়ির গেটে তালা মারা। দরজা ভাঙচুরের কোন আলামত চোখে পড়েনি। তবে ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা গেছে ভিতরের সেলাই ম্যাশিন, ফ্রিজ, হিরো হুণ্ডা মটর সাইকেল, ড্রেসিং টেবিলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাংচুর করা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। বাইরে রাখা পানির ট্যাংক ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাশের ঘরে অবস্থান করছেন বৃদ্ধ আব্দুল মাজেদ ও তার স্ত্রী আনিছা খাতুন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে শাওন ও তার মাকে মারপিট করে পুলিশে দেওয়ার পর থেকে গৃহকর্তা আবু সাঈদ, তার বাবা আব্দুল মাজেদ ও মা আনেছা খাতুনকে বাড়িতে আসতে দেখেননি। মিটিং করে মামলা না করার শর্তে কামরুল হাজী ও কাশেমপুর দাখিল মাদ্রাসা সুপার ও আগরদাঁড়ি ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর শেখ মনিরুজ্জামানের কথামত ৪০ লাখ টাকা বা বাইপাসের ৫ কাঠা জমি লিখে দিতে রাজী না হওয়ায় কামরুল হাজীর কাছে থাকা চাবি দিয়ে রাতে তালা খুলে ৬ সেপ্টেম্বর রাতে আবু সাঈদের বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। লুটপাট শেষে হামলাকারিরা দরজায় আবারো তালা লাগিয়ে দেয়। পরে সাঈদের বাবা দরজায় আরো একটি তালা লাগিয়ে দেন। লুটপাট করা মালামাল লুটপাটকারিরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। হজ যাত্রীদের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নামে বহু লোকের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণা করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগে কামরুল হাজী গত বছরের ৫ আগষ্টের আগে কয়েক বছর আত্মগোপনে ছিলেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী সহকারি কাশেমপুর গ্রামের মোঃ আবু সাঈদ জানান, আইনজীবী পেশার পাশাপাশি তিনি অবসর সময়ে ইজিবাইক চালান। বাবা ও মা তারই ঘরের পাশে পৃথকভাবে থাকেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর বৈকারীর একটি মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর পরপরই প্রতিবেশি মুরছালিনের পানিতে ডুবিয়ে মৃত্যুর অভিযোগে তার ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শাওনকে আটক করে নির্যাতনের পর গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখার খবর পান। রান্না করা অবস্থায় ছেলেকে বাঁচাতে মা নাজমা আক্তার এগিয়ে গেলে তাকেও বেধড়ক পিটিয়ে বেঁধে রাখা হয়। পরে ছেলে ও মাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। নামাজ শেষে তিনি পাড়ায় এসে ইজিবাইকটি তালা মেরে পাখর নজরুলের বাড়িতে রেখে হাজী কামরুলের বাড়ির পাশে একটি বাড়িতে অবস্থান নেন। তার উপর হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি কয়েক মিনিট পর সেখান থেকে চলে আসেন।

ওই দিনই তার বাবা ও মাকে অন্যত্র নিয়ে আসা হয়। পরে তারা বাড়িতে ফিরে যায়। বিকেলে তার বাড়ির পাশের বেড়া ও দুটি পানির ট্যাংকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাংচুর করা হয়। এরপরপরই মাদ্রাসা শিক্ষক শেখ মনিরুজ্জামানের কথা মত কামরুল হাজী তার (সাঈদ) বাড়ির গেটে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে যান। ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ১১ মিনিট থেকে সাত মিনিট ৪১ সেকে- ও সকাল ১০টা ৫৭ মিনিট থেকে ০১৭০৬-৬১৮৬৫৫ নং মোবাইল থেকে ৪ মিনিট ৫৪ সেকে- তার (সাঈদ) সঙ্গে কথা বলেন কাশেমপুর মাদ্রাসার সুপার ও আগরদাঁড়ি ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর শেখ মনিরুজ্জামান। একই দিনে সকাল সাতটা ৫২ মিনিট থেকে তিন মিনিট ৩৩ সেকে- ও ৮ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে তিন মিনিট ১৭ সেকে- ০১৭১১-০১১১৯৭ মোবাইলে কথা বলেন হাজী কামরুল। শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, ময়না তদন্ত না করে লাশ ফিরিয়ে আনলে কত দিতে পারবে।

৬ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বললে তিনি ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। একই দিনে হাজী কামরুল বলেন, ৪০ লাখ টাকা দিতে না পারলে বাইপাসের ৫ কাঠা জমি লিখে দিতে হবে। এ সময় লাউড স্পিকারে গোলাম রসুলের কণ্ঠে শোনা যায়, শুধু জমি লিখে দিলে হবে না তাকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। আর গ্রামে আসলে হবে না। প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় ৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে মুরছালিনের মরদেহ দাফনের পর হাজী কামরুল, শেখ মনিরুজ্জামান ও গোলাম রসুলসহ কয়েকজন শওকত সরদারের বাড়িতে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

একপর্যায়ে হাজী কামরুলের কাছে চাবি থাকার সূযোগে তাদের পরিকল্পনা মাফিক গেটের তালা খুলে ৬ অক্টোবর রাতে চেয়ারম্যানের কাছের লোক বলে পরিচিত গোলাম রসুল, একই এলাকার গফ্ফর, নূর হোসেন, হেলাল, বেলাল ও তাদের বোন সেলিনা, হাফিজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মারিয়ম, সালমা, কিবরিয়া ও জুয়েলসহ ২০/২৫জন তার বাড়ির তালা খুলে ঘরে ঢোকে। তারা দুটি আলমারির তালা ভেঙে ১০ ভরি সোনার গহনা, কাপড়, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার ভেঙে দুই লাখ নগদ টাকা ও চারটি মোবাইল, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র লুট করে। হামলাকারিরা তার ঘরের জানালার গ্লাস, মটর সাইকেল, সেলাই মেশিন, ফ্রিজ, টেলিভিশন, টেবিল ফ্যানসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাংচুর করে নিজেদের তালা লাগিয়ে দেয়। ধারালো জিনিস দিয়ে বালিশ ছিঁড়ে ফেলা হয়। কয়েকদিন পর তার বাবা দরজায় একটি তালা মেরে আসলে সেটিও রাতে ভেঙে ফেলা হয়। ভাঙচুর ও লুটপাটে তার ২২ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ৬ সেপ্টেম্বর ইজিবাইকের তালা ভেঙে পাখর নজরুলের বাড়ি থেকে আব্দুল বারীর বাড়িতে রাখা হয়। তাদের হামলার ভয়ে এক মাস যাবৎ তিনি বাড়ি ফিরতে পারছেন না। তার ছেলে শাওনের বয়স ১০ বছর আট মাস ছয়দিন হলেও তাকে ফাঁসাতে মামলায় বয়স ১৯ দেখানো হয়েছে। এমনকি জামিনে মুক্তি পেলে ছেলে ও স্ত্রীকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি।

এ ব্যাপারে হাজী কামরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনীত ৪০ লাখ টাকা বা ৫ কাঠা জমি সাঈদকে লিখে দেওয়ার জন্য বলা, হজ যাত্রীদের টাকা প্রতারণা ও সাঈদ টাকা না দেওয়ায় বা জমি লিখে না দেওয়ায় বাড়িতে লুটপাট ও ভাংচুরের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, সাঈদের এলাকায় কোন সুনাম নেই। সাঈদের স্ত্রী ৫ কাঠা জমি লিখে দিতে চেয়েছিল মৃতের পরিবারের নামে। এজন্য সাঈদ তার চাচা আব্দুর রশিদ ও ভগ্নিপতি রেজাউল ইসলামসহ কয়েকজনকে পাঠিয়েছিল তাদের কাছে। বিষয়টি নিয়ে শওকত সরদারের বাড়িতে বসাবসি হয়। এ সময় সাঈদ মোবাইল ফোনে দুই কাঠা জমি দিতে চাইলেও থানায় মামলা হওয়ায় সমাধান হয়নি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কবীর হোসেন মিলনের কথামত যাতে কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয় সেজন্য ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে তিনি একটি তালা লাগিয়েছিলেন সাঈদের বাড়িতে। তালা লাগানোর পর তিনি চাবি শেখ মনিরুজ্জামানের কাছে দিয়ে দেন। পরে সাঈদের পরিবারের লোকজন ওই তালা ভেঙে দুটো তালা মেরেছে। তবে মাহফুজুর রহমানের বয়স জন্ম নিবন্ধন সনদে উল্লেখিত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করেন তিনি।

আগরদাঁড়ি ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর শেখ মনিরুজ্জামান অসুস্থ হয়ে ঢাকার রামপুরের বেটার লাইফ হাসপাতালে রয়েছেন উল্লেখ করে আবু সাঈদের কাছে কোন টাকা বা জমি চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তিনি ফোন করেননি, সাঈদ তার কাছে কয়েকবার ফোন করেছিল। সাঈদের স্ত্রীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ৫ কাঠা জমি লিখে দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে বলতে বলতে চলে যান। চাচা কামরুল হাজীর ফোন থেকে সাঈদের সাথে কথা হলে চাচা স্ট্যাম্প ভেণ্ডর আব্দুর রশিদের উপস্থিতিতে দুই কাঠা জমি লিখে দেবে বলে। একপর্যায়ে হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষ হয়। ক্ষুব্ধ লোকজন সাঈদের বাড়ির পাশে বেড়া ও দুটি পানির ট্যাংক ভাংচুর করে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখভাল করতে বলায় তিনি স্থানীয় লোকজনদের সতর্ক করেন। এমনকি তারই পরামর্শে কামরুল হাজী নিজে সাঈদের ঘর তালা মেরে চাবি নিয়ে যান। বাড়ির ভিতরে ভাংচুর ও কেন সাঈদ বাড়িতে আসতে পারছে না বিষয়টি তার জানা নেই বলে দাবি করেন তিনি।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক ফারুক আলী মোড়ল জানান, মামলাটি তদন্তাধীন। ময়না তদন্ত প্রতিবেদন শনিবার বিকেল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ০৪, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

০৪ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test