E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

কেন্দুয়ায় অর্ধ শতাব্দি পর উন্মোচিত হলো বাউল কবি দীন শরৎ স্মৃতি ফলক ও জালাল মঞ্চ 

২০২৫ অক্টোবর ১৫ ১৯:৩১:১৩
কেন্দুয়ায় অর্ধ শতাব্দি পর উন্মোচিত হলো বাউল কবি দীন শরৎ স্মৃতি ফলক ও জালাল মঞ্চ 

সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : লোকজ সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে খ্যাত নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। লোকজ ঐতিহ্যের এই ধারাকে ঠিকিয়ে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে লোকজ সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস তুলে ধরতে অর্ধ শতাব্দি পর উন্মোচিত হলো বাউল কবি দীন শরৎ স্মৃতি ফলক ও মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খা স্মরণে জালাল মঞ্চ। 

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদ চত্তরে জালাল মঞ্চের শুভ উদ্বোধন করেন নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ্ আল মাহমুদ জামান। এর আগে অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত নলীনি রঞ্জন সরকারের শৈশব স্মৃতি বিজড়িত কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের সাজিউড়া গ্রামের পৈতৃক বাড়ির পুকুর পাড়ে বাউল কবি দীন শরৎ চন্দ্র নাথের স্মৃতি ফলক উন্মোচন করেন তিনি।

উপজেলা প্রশাসনের অর্থায়নে ও কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের পরিকল্পনায় বাউল কবি দীন শরৎ স্মৃতি ফলক ও মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খা স্মরণে ‘জালাল মঞ্চ’ উদ্বোধন হওয়ায় কেন্দুয়ার সকল শ্রেণি পেশার মানুষ আনন্দিত ও গর্বিত। উদ্বোধন কালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ জামান বলেন, লোকজ সংস্কৃতির রাজধানী কেন্দুয়ায় লোকজ ধারার অনেক গুণী মহাজন ও দেশ বরেণ্য শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এখানকার কবি সাহিত্যিক শিল্পী ও গণমাধ্যম কর্মীদের দাবির মুখে একমত প্রকাশ করে আমিও বলবো কেন্দুয়ায় ‘লোকজ সাহিত্য সংস্কৃতির একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এজন্য আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ বিষয় নিয়ে লিখবো।

জালাল উদ্দিন খা ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সিংহেরগাঁও গ্রামে তিনি পরলোক গমন করেন। সরকার তাঁর লোক সাহিত্য ও সৃষ্টি কর্মের মূল্যায়ন করে ৫২ বছর পর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করেন। বিংশ শতাব্দির ২০ থেকে ৬০ দশক অবদি এই গীতি কবি তাঁর সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। তিনি আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। তাঁর জীবদ্দশায় ৪ খন্ডের জালাল গীতিকা গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়। তাঁর মহা প্রয়ানের পর প্রকাশিত হয় জালাল গীতিকা পঞ্চম খন্ড। সেই খন্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় জালাল গীতিকা সমগ্র। যার সম্পাদনা করেন বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকার।

অপরদিকে বাউল কবি দীন শরৎ চন্দ্র নাথ ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন। তাঁর সৃষ্টি কর্মের মূল্যায়ন করে তাঁর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য ৮৪ বছর পর তাঁর জন্মস্থান সাজিউড়ায় উন্মোচন করা হয় বাউল কবি দীন শরৎ স্মৃতি ফলক। বাউল কবি দীন শরৎ মাত্র ৫৪ বছর বয়সে যেসব গান রচনা করেছেন এর মধ্যে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে দীন শরতের বাউল গান, যে গ্রন্থটি ১৩৩০ বঙ্গাব্দে ভারত প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা করেন শ্রী কামিনী কুমার কর রায়। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে দীন শরতের গৌরগীতি ভারত প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এটিরও সম্পাদনা করেন শ্রী কামিনী কুমার কর রায়। ১৩৪২ বঙ্গাব্দে শ্রী কামিনী কুমার কর রায়ের সম্পাদনায় ভারত প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয় দীন শরতের এসলাম সঙ্গীত।

এছাড়া ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে শরৎগীতি সম্পাদনা করেন সঞ্জয় কান্তি দেব। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোক সাহিত্য গবেষনা একাডেমি নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত হয় রাখাল বিশ্বাস সম্পাদিত দীন শরতের মালজোড়া গান। বাউল কবি দীন শরৎ ছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী। তিনি ছিলেন গৃহী বাউল। পাঠশালার চৌকাটে পা রাখতে পারেনটি ঠিকই কিন্তু সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য মালজোড়া গান ও নিগুড় তথ্য নিয়ে গুরুশিষ্য ধারা বাউল গান। শরৎ ভিটার অদূরে ৮৪ বছর পরে হলেও লোকজ সংগ্রহশালা ও গণপাঠাগারের দাবির মুখে দীন শরৎ স্মৃতি ফলক উন্মোচন হওয়ায় লোকজ সংগ্রহশালা ও গণপাঠাগার পরিবার উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাঈম-উল ইসলাম চৌধুরীর সঞ্চালনায় জালাল মঞ্চ উদ্বোধনকালে শুভেচ্ছা বক্তব্যে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, লোকজ সংস্কৃতির রাজধানী কেন্দুয়ায় জালাল মঞ্চ ও বাউল কবি দীন শরৎ স্মৃতি ফলক নির্মাণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

তিনি বলেন, এখানকার লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে দেশে বিদেশে গবেষনা চলছে। লোকজ এই সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা ঠিকে থাকুক অনন্তকাল এ আশা করি। নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক তানভীর জাহান চৌধুরী শুভেচ্ছা বক্তব্যে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

নেত্রকোনা জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ম, কিবরিয়া চৌধুরী হেলিম বলেন, লোক সাহিত্য সংস্কৃতির জেলা নেত্রকোনা হলেও এর মগজ (মস্তিষ্ক) কেন্দুয়া। কেন্দুয়ায় গুনী লোক সাহিত্যিক শিল্পীদের স্মৃতি ধরে রাখার দাবি জানান তিনি। উদ্বোধন উপলক্ষে জালাল মঞ্চে জালাল গীতি পরিবেশন করেন প্রখ্যাত বাউল শিল্পী সুনীল কর্মকার।

তিনি গানের সুরে সুরে বলেন, ‘থাকতে ক্ষুধা প্রেম সুধা পান কররে পাগল মন’। জালালের গান পরিবেশন করেন বাউল শিল্পী সালাম সরকার ও মুকুল সরকার। লোক শিল্পী পালা গায়ক আব্দুল কদ্দুছ বয়াতী নেচে গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন আনন্দে ভরে দেন। তিনি তার পালা গানের সুরে সুরে বলেন, ‘সাধের পাগলা ঘোড়ারে, কই তইয়া কই লইয়া যাও’।

(বিএস/এসপি/অক্টোবর ১৫, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৫ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test