E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফরিদপুরে আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় আদালতে হত্যা মামলা

২০২৫ নভেম্বর ০১ ১৩:৫১:৫৫
ফরিদপুরে আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় আদালতে হত্যা মামলা

রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুরে আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় আদালতে একটি হত্যা মামলা করেছেন নিহত গর্ভবতী গৃহবধু সুমাইয়া ইসলাম (২৩) এর মা ছাবিনা আক্তার (৩৮)। এদিকে, ফরিদপুরের সদরপুরে পাঁচ বছর বয়সী ছেলে শিশুকে গলাকেটে হত্যা ও গর্ভে থাকা আরেক শিশু জন্মের মাত্র ৬ দিন আগে তার গর্ভবতী মা সুমাইয়ার নিহতের ঘটনার দিন তাঁর স্বামীর করা মামলায় এ ট্রিপল হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে, কাজ করছে পুলিশ। আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের এ বিষয়টির পুরোপুরি রহস্য উন্মোচন হতে অপেক্ষা করতে হবে মরদেহের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট  ও তদন্তের বাকী কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত।

এর আগে, এ হত্যাকাণ্ডের শুরুতে দুই সন্তান সহ নিহত ওই মায়ের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচিত হবে কিনা, সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন ফরিদপুর জেলা সদরের কৈজুরি ইউনিয়নের সাচিয়া গ্রামের নিহতের নিজ এলাকার কিছু জনসাধারণ, প্রতিবেশি ও স্বজনেরা। এতে তারা কঠোর সমালোচনার মুখে ফেলেন সুমাইয়ার পরিবারকে। অবশেষে নিহত সুমাইয়ার মা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করলে সকল সমালোচনা মিথ্যা বলে প্রমানিত হলো সমালোচকদের কাছেই।

ওই ঘটনায় নিহতরা হলেন- ফরিদপুর সদরপুর উপজেলা কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের পূর্বকান্দি গ্রামের রমজান শেখের স্ত্রী এনং জেলা সদরের কৈজুরি ইউনিয়নের প্রবাসী সাচিয়া গ্রামের রমজান খানের মেয়ে সুমাইয়া ইসলাম (২৩), ভূমিষ্ট হওয়ার ৬ দিন আগে মাতৃগর্ভে নিহত শিশু এবং ঘরের বিছানায় গলা কেটে হত্যার শিকার হওয়া ছেলে হুজাইফা (৫)।

এর আগে, নিহত সুমাইয়ার প্রবাসী বাবার বাড়ির পাড়া প্রতিবেশী ও নিকট আত্নীয়দের দাবি করেন, নিহত সুমাইয়া, তার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার মাত্র ৬ দিন আগে নিজের প্রথম সন্তানকে খুন করে পেটের আগত সন্তান সহ আত্মহত্যা করার যে প্রচারণা চালানো হয়েছিলো, তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রনোদিত বলে মনে করেন তারা। কারণ হিসেবে তারা তখন জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকে তারা সুমাইয়া কে চিনেন জানেন, তাদের জানা মতে সুমাইয়া এভাবে আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে তিনি নন। তাদের হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে, নিহত সুমাইয়ার পরিবার থেকে শুরুতে কোনো মামলা না করার সাচিয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তি সন্দেহ প্রকাশ করেন এ হত্যাকাণ্ডে সুমাইয়ার স্বামী রমজান মুন্সীর সাথে নিহতের নিজ পরিবারের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, বা লেনদেনের মাধ্যমে তা সমাধান হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে দাবি তুলেন। এমনকি তারা সুমাইয়ার নিজের মা'কে নিহতের স্বামীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্ন তুলে স্টেটমেট দেন। তবে, পরে এ প্রতিবেদকের অধিকতর তদন্তে বেড়িয়ে আসে, কমিনিউকেশন গ্যাপের কারণে নানাভাবে সন্দেহের তালিকায় রেখে মনগড়া বক্তব্য দিয়েছিলেন সাচিয়া গ্রামের লোকজন। মুলতঃ নিহত সুমাইয়ার বাবা প্রবাসে ও অসহায় শোকার্ত মা বাপের বাড়ী থাকায় ও পরিবার থেকে মামলা না করায় ওমন মনগড়া ও ভিত্তিহীন সমালোচনা করতে থাকেন তারা। অবশ্য ওই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হতে সুমাইয়ার মায়ের সাথে কথা বলতে ওই সময় গত ৮ অক্টোবর থেকে ১১ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত, পরপর চারদিন সাচিয়া গ্রামে তাদের স্থায়ী বসত বাড়িতে গেলে ওই ভদ্রমহিলাকে খুঁজে না পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ধোয়াশায় থাকে এই প্রতিবেদকও। তার বাড়িটি তালাবদ্ধ থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করতে পুলিশের সাহায্য নিয়ে তার ব্যবহৃত একটি একটিভ মোবাইল (গ্রামীণফোন) নম্বরে বেশ অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার সাথে কথা বলতে ব্যর্থ হয় এই প্রতিবেদক।

তবে, সম্প্রতি সুমাইয়ার মা ছাবিনা আক্তার ও প্রবাসী বাবা রমজান খানের সাথে কথা হলে অনেক কিছু খোলাশা হয়। এসময় নাতী ও গর্ভবতী মেয়ে হারানো ওই শোকার্ত মা জানান, 'ওসব অভিযোগ যারা করেছে তারা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথাবার্তা বলেছেন। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি হতে পারে না' জানিয়ে তিনি আরও বলেন,' কতিপয় ওসব কুৎসিত মানুষের প্রতি নিন্দা জানাই, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুক।'

সুমাইয়ার মায়ের কথার সূত্র ধরে, ওই সমালোচকদের কাছে তাদের দেওয়া পুর্বের স্টেটমেন্ট শুনিয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা তখন সূর পাল্টিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, 'সুমাইয়ার মা ও তাঁর পরিবার মামলা না করায় তারা ক্ষোভে কষ্টে এসব বলেছিলেন। তারা প্রায় সকলে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, 'আমরা রমজান খান ও তার বউকে ভুল বুঝেছিলাম। সম্প্রতি সুমাইয়ার মা মামলা করলে ও নিজের সাচিয়ার বাসায় উপস্থিত হয়ে সবার সাথে কথা বললে তাদের এ ভুল বোঝাবুঝি হতো না বলেও জানান তারা।

এদিকে, নিহত সুমাইয়ার মায়ের সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, ওই সময় মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে নিজের সন্তান ও তার নাতীর মৃতদেহ দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই তিনি তাঁর প্রবাসী স্বামীর সাথে যোগাযোগ করে বাচ্চাদের নিয়ে সদরপুরে বাপের বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। তাছাড়া, এরপর সদরপুর থানায় মামলা করতে গিয়েও তিনি মামলা করতে পারেননি বলেে জানান। তিনি আরও জানান, পরিস্থতি তাকে এতোটাই অসহায় ও ভীত করে ছিলো যে, তিনি একা মহিলা মানুষ কি করবেন তা কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এ বিষয়ে সদরপুর থানার পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকদেব রায় 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে জানান, ওই সময় এ বিষয়ে একটি মামলা হয়েছিলো। তবে, মামলা হওয়া আগে মেয়ের পরিবারকে ডাকা হয়েছিলো। তখন মেয়ের জামাইয়ের সাথে তারা সবাই পরামর্শ করেন। পরে, মেয়ের জামাই রমজান মুন্সী (৩০) বাদী হয়ে সদরপুর থানায় মামলা করেন, বলে জানান ওসি সুকদেব রায়।

এদিকে, গ্রামের অসাধু ও নোংরা সামালোচোকদের মুখে ছাই দিয়ে ফরিদপুর বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ৫ নং আমলী আদালতের একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত সুমাইয়ার মা মোসা. ছাবিনা আক্তার (৩৮)।

গত ১২ অক্টোবর ২০২৫ ইং তারিখে করা ওই মামলায় মেয়ের জামাই রমজান মুন্সী (৩০)সহ মোট ৫ জনকে আসামি করেছেন ছাবিনা। এ মামলায় অন্যান্য আসামীরা হলেন যথাক্রমে- নিহত সুমাইয়ার দেবর সোহাগ মুন্সী (২৭), সোহাগের স্ত্রী ফারহানা (২১), নিহত সুমাইয়ার শ্বশুর মোতালেব মুন্সী (৬০) ও শ্বাশুড়ি নার্গিস বেগম (৫০)।

এদিকে, প্রবাসী রমজান খানের স্ত্রী ও নিহত সুমাইমায় মা মোসা. ছাবিনা আক্তারের আদালতে করা হত্যা মামলা (দণ্ড বিধি: ৩০২/৩৪ ধারা) এর বিষয়টি অবগত আছেন জানিয়ে সদরপুর থানার ওসি সুকদেব রায় জানান, 'সুমাইয়ার মা আদালতে মামলা দায়েরের পর বিজ্ঞ আলাদত আমাদের কাছে এ বিষয়ে কিছু বিষয়ে জানতে চেয়েছেন, আমি আলাদতের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলাটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই আলমগীর শরীফকে যথায়ত নির্দেশনা দিয়েছি।'

উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের পূর্বকান্দি গ্রাম থেকে স্থানীয় রমজান মুন্সীর দ্বিতীয় স্ত্রী গর্ভবতী সুমাইয়া বেগম (২৩) এবং ছেলে হুজাইফা (৫) লাশ উদ্ধার করে সদরপুর থানা পুলিশ। এ সময় সুমাইয়ার স্বামী এবং তার পরিবার থানা পুলিশ ও স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, ২৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত থাকা গর্ভবতী গৃহবধূ সুমাইয়া ইসলাম (২৩) তাঁর শিশু সন্তান হুজাইফাকে গলা কেটে হত্যা করে নিজে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, আশেপাশের লোকজন বিষয়টি জানতে পেরে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয় বলে জানানো হয়। পরে এসব কথাবার্তা উল্লেখ করে নিহত গর্ভবতী সুমাইয়ার স্বামী ও জবাই করে হত্যার শিকার হওয়া শিশু হুজাইফার বাবা রমজান মুন্সী (৩০) বাদি হয়ে সদরপুর থানায় একটি অভিযোগ দ্বায়ের করেন।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) সদরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকদেব রায় জানান, 'নিহত গর্ভবতী গৃহবধু সুমাইয়ার ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে আসলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হবে। সেক্ষেত্রে মামলাটির মুটিভ চেঞ্জ হয়ে ঘটনাটি যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে, বা একই থাকতে পারে। সবই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ও মামলাটির সম্পুর্ণ তদন্তের ওপর নির্ভর করছে বলেও জানান ওসি সুকদেব।

এছাড়া, মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার শুরু থেকে তদন্তের দায়িত্বে থাকা সদরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর শরীফ জানান, 'আমি সম্ভাব্য সব দিক বিবেচনা নিয়ে মামলাটির তদন্তের কাজ করে যাচ্ছি। সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এ ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, অনেক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে মসমলাটির তদন্তের কাজ অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে, আশা করি নিহতদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসলে, চলমান তদন্তের পাশাপাশি বাকী তদন্তের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলেও জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা আলমগীর শরীফ।

এদিকে, প্রবাসে থাকা নিহত সুমাইয়ার শোকার্ত বাবা রমজান খান এ বিষয়ে জানান, 'আমার মেয়ের জামাই রমজান মুন্সী দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় বিপুল পরিমান অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ওই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তার অর্থসম্পদ ই বেশি। প্রবাসে থেকে টাকা পাঠিয়ে দেশে জমিজমা কিনে বাড়ী নির্মাণ সহ সবকিছু তার টাকায়ই হয়েছে। অথচ তার নির্দেশনায় অমান্য করে জামাইয়ের বাবা জামাইয়ের নামে জমির দলিল না করে, নিজের নামে বাড়ীর জমি কিনেন। এতে জামাইয়ের সাথে তার যৌথ পরিবারের মধ্যে বাকবিতণ্ডাও হয়েছিলো। জামাই আমার মেয়েকে ভালোবাসতেন বলেই জানতাম, তবে তার পরিবার এসব সহ্য করতে পারতো না। এমনকি আমার মেয়েকে জামাই কিছু দিলে, বা তার নামে কিছু করতে চাইলে, সেটাই তার পরিবার কখনোই তা চায়নি। জামাইও তার পরিবারের প্রতি খুবই অনুগত ছিলো। পরিবারের কথার বাইরে যেতো না। এসবের মধ্য দিয়েই ওই পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হয়তো আমার নাতী সহ আমার গর্ভবতী মেয়ে হত্যা শিকার হয়ে থাকতে পারে।'

এদিকে, নিহত সুমাইয়ার মা ছাবিনা আক্তারের ফরিদপুর আদালতে করা হত্যা মামলায়- সুমাইয়ার স্বামী রমজান মুন্সী ও তার পরিবারের সম্পৃক্ততার কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, নিহত সুমাইয়া ও তাঁর দুই শিশু সন্তানের হত্যা রহস্য উন্মোচিত হবে এমনটি আশা প্রকাশ করছেন তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনেরা। এছাড়া, এ নির্মম তিন গণহত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের পর সঠিক বিচার নিশ্চিত হলে সন্তান ফিরে না পেলেও কিছুটা মনে প্রশান্তি পাবেন বলে মনে করছেন- নিহত গর্ভবতী গৃহবধু সুমাইয়া ইসলামের প্রবাসী বাবা রমজান খান ও শোকার্ত গৃহকর্মী মা মোসা. ছাবিনা বেগম।

(আরআর/ এএস/নভেম্বর ০১, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

০১ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test