E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি

২৮ বছরেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে, কমেনি অস্থিরতা

২০২৫ ডিসেম্বর ০২ ১৯:৪০:০৪
২৮ বছরেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে, কমেনি অস্থিরতা

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি : আজ পার্বত্য চুক্তির ২৮ বছর পূর্তি। ঠিক ২৮ বছরে আগে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন হাসিনা সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গেরিলা নেতা সন্তু লারমার মধ্যে সাক্ষরিত হয়েছিল ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির। এই চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্য ছিল সংশ্লিষ্টদের। তবে ২৮ বছরেও পার্বত্য চুক্তি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পারেনি। উল্টো বেড়েছে খুন- অপহরণ, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, চাঁদাবাজি ও সাম্প্রদায়িক ডাঙা।

চুক্তির পর পাহাড়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে আরও ছয়টি সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন। এরা হলো—জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ), জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ), ইউপিডিএফ (সংস্কার), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও মগ লিবারেল ফ্রন্ট।

চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে এই গ্রুপগুলোর মধ্যে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এক হিসাবে, চুক্তির পর ২৮ বছরে আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে ৬ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। বার্ষিক চাঁদার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে কৃষক-জেলে—সবাইকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয়।

চলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন করার নানা ষড়যন্ত্র। আর এতে ভারত ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। তিন পার্বত্য জেলায় ১৩ হাজার বর্গমাইল সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সন্ত্রাসীরা ভারতের ওপারে বসে অস্ত্র পাচার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ অবস্থায় পাহাড়ে নতুন করে সেনাক্যাম্প স্থাপন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ও ভারত সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে পার্বত্য চুক্তিকে কেন্দ্র করে এখনো মুখোমুখি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস, সরকার ও স্থানীয় বাঙালিরা। দীর্ঘ সময়েও অবসান হয়নি চুক্তি নিয়ে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ।সরকার চুক্তির ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে দাবি করলেও এ বিষয়ে জেএসএস-এর অসন্তোষ আছে। তাদের দাবি চুক্তির মৌলিক বিষয় সরকার বাস্তবায়ন করেনি। অপরদিকে স্থানীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, পার্বত্য চুক্তি একপেশে ও দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চুক্তিতে পাহাড়ের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালিদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে।

এদিকে, পার্বত্য চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান কাজি মুজিবর রহমান বলেন, মূলত ভারতের ইন্ধনে বৈষম্যমূলক পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বাঙালি ও পাহাড়িদের মতামত না নিয়ে এ চুক্তি সম্পাদন করায় পাহাড়ে শান্তি আসেনি। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ চুক্তি বাতিল না হলে পাহাড়ে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয় বলে মত দেন কাজি মুজিবর।

অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, চুক্তির মূল বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে শান্তি ফিরছে না। তাদের দাবি চুক্তি মোতাবেক পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি। পার্বত্য এলাকাকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিশেষ প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেওয়া, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে বিশেষ ক্ষমতা হস্তান্তরে অগ্রগতি নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি এবং সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, বাঙালি বসতি স্থাপনকারী ও স্থানীয় পাহাড়িদের মধ্যকার অবিশ্বাস এবং ভূমি নিয়ে বিরোধ শান্তি প্রক্রিয়ার প্রধান বাধা। এছাড়া পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নতুন করে সৃষ্ট সশস্ত্র গ্রুপগুলোর তৎপরতাও শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করেছে। পূর্ণাঙ্গ শান্তি বাস্তবায়নের জন্য ভূমি কমিশনকে দ্রুত কার্যকর করা,স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া এবং সব পক্ষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

রাঙ্গামাটি বাসিন্দা প্রফেসর হারুনুর রশীদ বলেন, সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ২৮ বছর অতিবাহিত করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতিতে খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি। সরকার কিছু বিষয় হস্তান্তর করলেও নানা আইনী জটিলতায় অনেক বিষয় হস্তান্তরে আগ্রহী হয়নি। তাছাড়া পাহাড়ে সশস্ত্র নানা দল এবং উপদলের কোন্দলে এখানকার মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এক কথায় বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় শুরু হওয়া পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে ছড়িয়ে পড়ে। এতে খাগড়াছড়িতে ৩ জন, রাঙ্গামাটিতে ১ জন নিহত হন; আহত হন ৫০ জনের বেশি এবং ১০২টি দোকানে আগুন দেওয়া হয়।

চুক্তির মূল বিষয়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রায় নিষ্ক্রিয়, হাজার হাজার অভিযোগ ফাইলবন্দী। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি অপূর্ণ। পার্বত্য অঞ্চলকে ‘আদিবাসী অধ্যুষিত’ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি।

সরকারের দাবি, চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়িত, বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চুক্তি পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন ও ভূমি কমিশনে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

(আরএম/এসপি/ডিসেম্বর ০২, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

০২ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test