E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ঝিনাইদহে রমরমা সুদের কারবারে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ

২০২৫ ডিসেম্বর ১৫ ১৪:০৭:১৮
ঝিনাইদহে রমরমা সুদের কারবারে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ

হাবিবুর রহমান, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহের গ্রামগঞ্জে আর শহরের অলিগলিতে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সুদের কারবার। অর্থনৈতিক চাপ, বেকারত্ব, ব্যবসায় লোকসান, আর সহজে ব্যাংক ঋণ না পাওয়ার সুযোগে অবৈধ সুদের কারবারিরা এখন জেলাজুড়ে যেন নতুন এক আধিপত্য গড়ে তুলেছে। সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে তারা। কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে আছে অমানবিক সুদের ফাঁদ, যা অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, সুদের টাকার এ বাজার এখন আর আগের মতো গোপন নেই। জনসমক্ষে, চায়ের দোকানে বসেই প্রকাশ্যেই স্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে দেয়া হচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টাকা হাতে পাওয়ার লোভে মানুষ অনায়াসে এসব ঋণ নেয়। তবে সুদ পরিশোধে গড়মিল হলেই শুরু হয় হুমকি-ধমকি, সামাজিক অপমান আবার কখনো কখনো তা গড়ায় আদালত পর্যন্ত।

ভুক্তভোগীরা জানান, সুদি কারবারিরা ঋণ দান করে মাসিক শতকরা ১৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত সুদ আদায় করে। এরা ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণ দেওয়ার সময় এরা ঋণ গ্রহণকারীর কাছ থেকে ব্যাংকের খালি পাতার চেকে স্বাক্ষর করে নেয়। এর পাশাপাশি সাদা স্ট্যাম্পেও স্বাক্ষর নিয়ে থাকে। টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ব্ল্যাংক চেকের পাতায় ইচ্ছেমত টাকার অংক বসিয়ে নেয়। তারপর মামলা মোকদ্দমার ভয় দেখিয়ে অতিরিক্তি টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। কোনো কোনো কারবারিরা আদালতে মামলা পর্যন্ত ঠুকে দেয় ঋণ গ্রহীতাদের নামে। কারবারিা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানা যায়, শৈলকুপার হরিহরা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন, ব্রাহিমপুর গ্রামের আমজাদ মোল্লা, রবিউল ইসলাম, রাসেল হোসেন,ভাটই বাজারের টিটু মোল্লা, চাঁদপুর গ্রামের আলতাফ হোসেন, আনারুল ইসলাম, রাজু হোসেন, শেখপাড়া এলাকার সিদ্দিক শেখ,সাঈদুর রহমান,কোরবান আলী, সারুটিয় এলাকার সুদে কানাই ও রবিউল ইসলাম, সাধুহাটি গ্রামের আব্দুল মান্নান মেম্বার, সদর উপজেলার পাগলাকানাই এলাকার গৌতম কুমার ঘোষ, কুলবাড়িয়া গ্রামের আলতাফ হোসেন, কালীগঞ্জের বড় তালিয়ান গ্রামের রেজাউল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম, কোটচাঁদপুর উপজেলার ফাজেলপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম, তালসার গ্রামের আলতাফ হোসেন, সাবদারপুর গ্রামের নাজির উদ্দিনসহ দেড় শতাধিক সুদি মহাজন গোটা জেলাব্যাপী দাপিয়ে বেড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ভূঁইফোড় সমিতি ও এনজিওর নামে দাদন ব্যবসা চালিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যাংক কর্মকর্তারা দাবি করছেন, নিয়মনীতি মেনে কাজ করতে হয় বলে অনেক সময় গ্রাহকদের দ্রুত ঋণ দেওয়া সম্ভব হয় না। আর এই সুযোগেই সুদের কারবারিরা মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করছে। তাদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

মহেশপুর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষক ওয়াহাব আলী বলেন, ‘ধান কাটার সময় জমির কাজের জন্য টাকা দরকার হয়েছিল। ব্যাংকে গেলে গ্যারান্টি চাই, কাগজ চাওয়াসহ নানান সমস্যা দেখায়। বাধ্য হয়ে সুদের কারবারির কাছ থেকে টাকা নিছিলাম। এখন মূল টাকার চারগুণ বেশি দিয়েও শেষ করতে পারতেছি না ঋণের টাকা।’

সদর উপজেলার টিকারী গ্রামের মুদি দোকানি রাজু আহমেদ বলেন, ‘কৃষি ব্যাংকের চেক দিয়ে এক প্রভাবশালী সুদের কারিবারির কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা সুদে নিয়েছিলাম। কয়েকমাসের মধ্যে সুদসহ পুরো টাকা পরিশোধ করে দিই। এরপরেও আদালতে ২০ লাখ টাকার মামলা ঠুকে দেয় ওই সুদের কারবারি।’

মানিবাধিকার কর্মী চন্দন বসু বলেন,‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সকল শ্রেনিপেশার মানুষ অভাব-অনটনের মধ্যে রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সুদের কারবারিরা। অনেক কারবারিরা বেতনভুক্ত কর্মীদের অ্যাটিএম কার্ড ও চেকবই পর্যন্ত তাদের কাছে রেখে দেয়। দিনমজুর থেকে ছোট ব্যবসায়ী সবাই সুদের কারবারিদের এই ফাঁদের শিকার হচ্ছে। এই অবৈধ সুদের চক্র এখন সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। অবৈধ সুদের কারবার শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই করছে না, সমাজে তৈরি করছে ভয়, আতঙ্ক আর অস্থিরতা। শিগগিরই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন আরো অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাবে।’

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজ হোসেন জানান, সুদের কারবার মূলত ব্যক্তিগত লেনদেন হওয়ায় ভুক্তভোগীরা এ নিয়ে অভিযোগ করতেও ভয় পায়। মামলা হলে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, আর না করলে সুদের কারবারিদের চাপ এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে জেলাজুড়ে সুদের কারবারিদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এসব কারবারিদের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো আইন করে ব্যবস্থ্যা নেওয়ার।’

(এইচআর/এএস/ডিসেম্বর ১৫, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test