E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১ জন ভাষাশহীদ একুশের কালজয়ী উত্তরাধিকারী

২০২৪ মে ২২ ১৬:০৪:৩৫
কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১ জন ভাষাশহীদ একুশের কালজয়ী উত্তরাধিকারী

গোপাল নাথ বাবুল


বিশ্বের নানা প্রান্তে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে পুরুষের হাতে হাত মিলিয়ে রক্তচোষার দলকে রুখে দাঁড়িয়েছেন অসংখ্য নারী। কিন্তু নিজ মায়ের মুখের বুলির মর্যাদা রক্ষার্থে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যাকার শিলচরে আত্মাহুতি দিয়ে বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ হিসেবে ইতিহাস হয়ে আছেন ১৬ বছরের এক কিশোরী। নাম তাঁর কমলা ভট্টাচার্য। সেদিন অসম আধা সামরিক বাহিনীর নির্বিচারে গুলিতে কমলাসহ মোট ১১জন বাঙালি মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আত্মবলিদান দেন। 

এ কথাগুলো লিখে ২০২০ এর ১৯ মে ভাষা শহীদদের স্মরণে আমার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিলে কলকাতার কয়েকজন বন্ধু হাসাহাসি শুরু করেন। ওরা আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি এসব ইতিহাস কোথায় পেয়েছি? ওদের প্রশ্ন করার ধরণ দেখে আমার একটু রাগ হয়েছিল। কিন্তু জানতাম, বাঙালিরা ভুলোমনা। সবকিছু তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। শুধু ওই বন্ধুরা নন, হয়তো বাঙালিদের অনেকে জানেন না, বাংলা ভাষার মান রক্ষার দাবিতে আসামের বরাক উপত্যাকায় অসম রাইফেলসের সদস্যদের গুলিতে বিশ্বের একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক কমলা ভট্টাচার্য শহীদ হয়েছিলেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি, ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বাঙালিদের কাছে যেভাবে গুরুত্ব বহন করে, সেভাবে হয়তো ভাষার জন্য কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১জন বাঙালির আত্মবলিদান অত্র অঞ্চলের বাঙালিদের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। তাই আমি খুব ঠান্ডা মাথায় সেদিন তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, বাঙালি হিসেবে তারা কতবড় অকৃতজ্ঞ।

মাত্র ৯ বছর আগে ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মাধ্যমে রক্তচোষার দল পাকিস্তানিরা যখন মায়ের ধ্বনি, মায়ের সুর, মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়, তখন তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতার বাংলার দামাল ছাত্র-জনতা গর্জে ওঠে। এ গর্জনই ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ ও জাতীয় চেতনার উম্মেষ। সেদিন মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার্থে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তল্পীবাহক পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, শফিকসহ আরো নাম না জানা অনেকে। বাংলার মানুষের দেশপ্রেম, মাতৃভাষাপ্রীতি ও আত্মত্যাগের প্রতি বিশ্ববাসির অকুন্ঠ স্বীকৃতিই হল আজকের ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
মায়ের ভাষার জন্য এপার বাংলার ভাষা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের ঢেউ আসামের বাঙালিদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তারাও মাতৃভাষার মান রক্ষার্থে অসমিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের শ্লোগান ছিল ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না’। সে আন্দোলন গ্রাস করেছিল বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ ষোড়শী কমলা ভট্টাচার্যকেও।

কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৫ সালে। তাঁর বাবার নাম রামরমণ ভট্টাচার্য এবং মায়ের নাম সুপ্রবাসিনী দেবী। চার বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে কমলা ছিল পঞ্চম। তাদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে। জন্মের মাত্র ২ বছর পর দেশভাগ হলে কমলার পরিবার পাকিস্তানে থেকে যান। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই গণভোটের মাধ্যমে ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে আসামের সিলেট (শ্রীহট্ট) জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। কিন্তু ১৯৫০ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিধনপর্ব শুরু হলে তার রেশ সিলেট অঞ্চলেও এসে পড়ে। ফলে কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হন এবং আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন।

এসময় পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালিদের সঙ্গে অসমিয়াদের একটা মানসিক সংঘাত শুরু হয়। অসমিয়ারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করলে অসংখ্য বাঙালি আসাম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন এবং অবশিষ্টদের বিরাট অংশ বরাক উপত্যাকায় চলে আসেন। এরপর ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামের তৎকালিন মূখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা’র সিদ্ধান্তে আসাম বিধান সভায় নতুন আইন ‘রাজ্য ভাষা বিল’ উত্থাপন করা হয় এবং ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে। কিন্তু ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ উপেক্ষা করে রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে ‘রাজ্যভাষা বিল’ চুড়ান্তভাবে পাশ করে। অথচ বরাক উপত্যাকার ৮০% জনগণের ভাষা ছিল বাংলা।

এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বাঙালিরা। ফলে শুরু হয় মাতৃভাষা আন্দোলন। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস আন্দোলনে রূপ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় আসে ১৯ মে, ১৯৬১ । সেদিন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বরাক উপত্যাকায় কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে হরতাল আহ্বান করা হয়। কমলা তখন ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্রী। শৈশবে বাবা মারা যাওয়ার পর চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ে যায় কমলাদের পরিবার। পাঠ্যপুস্তক কেনার ক্ষমতা ছিল না কমলার। সতীর্থদের কাছ থেকে বই ধার করে পড়তে হত কমলাকে। কমলার মেজদিদি প্রতিভা ভট্টাচার্য ছিলেন শিক্ষিকা। কমলার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে প্রতিভার আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বড়বোন বেণু নার্সের চাকুরি পেয়ে প্রশিক্ষণ নিতে শিমুলগুড়ি চলে যান।

কমলা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে বাংলাভাষা আন্দোলনে যোগ দেবেন। ১৭ মে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে ৭/৮ বছরের ছোটবোন মঙ্গলাসহ আরো ২২ জন তাঁরই বয়সি কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ১৯ মে’র হরতালে যোগ দেন। দুপুরের পর কমলা হরতালে পিকেটিং করার উদ্দেশ্যে মেজদিদি প্রতিভার নিষেধ উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর মা একটুকরা কাপড় দিয়ে বলেছিলেন, পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়লে কাপড় ভিজিয়ে চোখে দেবে। বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বের হওয়া ছোটবোন মঙ্গলার জেদাজেদির কারণে মঙ্গলাকেও সঙ্গে নিতে বাধ্য হন কমলা।

শিলচর রেলস্টেশনে সেদিন ভোর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন আন্দোলনকারি বাঙালিরা। পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তারা শ্লোগান দিতে থাকে, ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না’। দুপুরের পরে আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। কমলা মঙ্গলাসহ তাঁর সাথীদের নিয়ে যখন শিলচর রেলস্টেশনে পৌঁছান, তখন চারিদিকে উত্তেজনা ও পরিবেশ ছিল থমথমে। শ্লোগানে শ্লোগানে বাতাস মুখরিত। এমন সময় গ্রেফতারকৃত কিছু পিকেটার নিয়ে পুলিশের একটি গাড়ি এসে হাজির হলে উত্তেজিত জনতা ট্রাকের চাকায় পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পিকেটারেরা ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন। রাজ্য সরকার এতে অস্থির হয়ে পড়ে। বেলা ২টা ৩৫ নাগাদ আসাম রাইফেলসের সদস্যরা লাঠিচার্জের সাথে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। চারিদিকে চেঁচামেচি ও হট্টগোলের মধ্যে মঙ্গলা কমলার হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যান।

কমলা দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে দেখতে পান, মঙ্গলা পুলিশের লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন এবং সাহায্যের আশায় কমলাকে চিৎকার করে ডাকছেন। কমলা আর দেরি না করে বোনের সাহায্যে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে মঙ্গলাকে টেনে তোলে আবার রাস্তা পার হতে প্রস্তুতি নেয়ার সময় একটা বুলেট কমলার ডান চোখ ভেদ করে মাথা চুরমার করে দিয়ে পেছন দিকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গলার হাত থেকে ছিটকে কমলা রাস্তায় পড়ে যান। বুলেটে ক্ষতবিক্ষত কমলার মাথা থেকে বিস্তর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। শিলচরের কালো পিচঢালা রাস্তা ততক্ষণে রক্তে লাল হয়ে যায়। মঙ্গলা দেখছেন, মূহুর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তাঁর সামনেই শত শত আন্দোলনকারি প্রাণ বাঁচাতে ছুটাছুটি করছেন আর তাঁর ছোড়’দি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তব্ধ হয়ে যান।

আহত ও গুলিবিদ্ধ লোকজনের সাথে কমলা ও মঙ্গলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই জীবনের মায়া কাটিয়ে কমলা ইহলোক ত্যাগ করেন এবং মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একমাস পর তার জ্ঞান ফেরে। কিন্তু মঙ্গলা শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে করে চিরদিনের জন্য অপ্রকৃতস্থ।

কমলার পথ ধরে সেদিন তরণী দেবনাথ, কানাইলাল নিয়োগী, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুনীল সরকার, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব, হিতেশ বিশ্বাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর ও সুকোমল পুরকায়স্থসহ মোট ১১ জন বাঙালি বাংলাভাষার সম্মান রক্ষার্থে আত্মাহুতি দেন।

আজ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, বাংলাভাষাকে অসম সরকারি ভাষার মর্যাদা দানে ১১ জন বাঙালির সাথে যে মেয়েটি আত্মাহুতি দিলেন, সে কমলা ভট্টাচার্যকে বর্তমান প্রজন্মকে চেনাতে বা জানাতে আমরা কতটুকু চেষ্টা করছি? কেন আমাদের তরুণদের কাছে কমলারা মডেল হচ্ছেন না? তাঁর আত্মত্যাগের কথা আমরা কয়জনই বা জানি? আমরা কী আমাদের সন্তানদের ‘কমলা’দের আদর্শে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি? আমরা কী আমাদের সন্তানদের কোনোদিন জানাতে চেষ্টা করেছি যে, বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ আমাদের কমলা?

ভাষা শহীদ স্টেশন হিসেবে একটা ট্রেন স্টেশনের নামকরণ এবং ওই স্টেশনের এক শহীদ বেদির ওপর কমলাসহ ১১জন শহীদের আবক্ষ মূর্তি ও একটি ব্রোঞ্জ ফলক, ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন, শিলচর পাবলিক স্কুলের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া সড়কটির নাম ‘কমলা ভট্টাচার্য সড়ক’ ছাড়া আর কীইবা আছে, যাতে বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলাকে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারে? বিজ্ঞজনদের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্নগুলো রেখে বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১ জন ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি এবং দাবি জানাচ্ছি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ এ বিষয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেবে। কারণ, বাংলা ভাষার জন্য প্রথম নারী শহীদ কমলা ভট্টাচার্যসহ ১১জন ভাষাশহীদ একুশের কালজয়ী উত্তরাধিকারি এবং উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার দৃপ্তবাহক ।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১৬ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test