E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পর্ব: ০৪

ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা 

২০২৫ মে ০৬ ১৭:০৭:১৩
ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা 

রহিম আব্দুর রহিম


১৯৭৬-১৯৭৭ এর দিকে যখন প্রথম পঞ্চগড়ে আসা যাওয়া শুরু করি, ওই সময় আমার উপস্থাপনায় তখনকার দিনের অন্যতম জনপ্রিয় তরুণ কণ্ঠশিল্পী ছিলো নকুল চন্দ্র বিশ্বাস, ওর গান 'আইসা মাসের বাইসা তারিখ, ঠিক হইছে মোর বিয়ের তারিখ' হাজারো দর্শককে মাতিয়ে তুলতো। যে কথা বলছিলাম, পঞ্চগড়ের সমৃদ্ধ লোকজপালা পেঁচকাটার সংসার একবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আমন্ত্রণে জাতীয় নাট্যশালায় শো করার সুযোগ পায়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় কোন সুযোগ বা আমন্ত্রণ তারা পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। এবার নববর্ষ-১৪৩২ বঙ্গাব্দ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত তিনদিনব্যাপী বৈশাখী লোক নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত গ্রাম লাঠুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। উৎসবের শেষদিন পরিবেশিত হয় ফকির সমে আলী সম্প্রদায়ের সত্যপীরের গান ‘বাহরাম বাদশা’। গীতি এবং নৃত্যনাট্যের সংমিশ্রণের পালার কাহিনী 'দানশীল এক বাদশার দান খয়রত করে নিজে ফকির হবার কাহিনী। 

বাদশা বাহরাম প্রতিদিন সকল থেকে দুপুর অবধি তাঁর রাজ্যের দরিদ্র, ভিখারিদের দান করেন, যে যা চান, তাকে তাই দেওয়া হয়। এক দুপুরে সত্যপীর এসে বাদশা বাহরামের কাছে স্বর্ণ-অলংকার ভিক্ষা চাইলেন, কিন্তু তখন বেলা অপরাহ্ন। এখন সম্ভব না। এছাড়া স্বর্ণ অলংকারও শেষ হয়েছে। তাই তিনি সত্যপীরকে পরেরদিন সকালে দান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন এবং সত্যপীরকে তার রাজমহলে রাত্রি যাপনের আমন্ত্রন জানান। এবার সত্যপীর, বাদশাহকে পরীক্ষার জন্য, তিনটি শর্তে দিয়ে বলেন, আমি যদি রাত্রিযাপন করি, তবে আমাকে আপনার 'ঈমান' দান করতে হবে।না হয় সমস্ত 'স্বর্ণমুদ্রা', তা না হলে 'রাজসিংহাসন'। রাজা বেকায়দায়, সকল স্বর্ণাদির ভান্ডার অনেক আগেই শেষ। ঈমান দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়; কি আর করার? দান করলেন তাঁর 'রাজসিংহাসন।' এবার বাদশার নিজেই ফকির।' উৎসবের দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা ছিলো আটোয়ারির হরিগুরু সম্প্রদায়ের ধামেরগান 'বাবার শেষ বিয়ে।’

পালাটির কাহিনী, ‘২ সন্তানের এক জনকের স্ত্রী মারা গেলেন। বৃদ্ধ বাবার বড় ছেলের বউ শ্বশুরকে ঠিকঠাক দেখভাল করা তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় খাবার দাবারও দেয় না। এমন অবস্থায় বৃদ্ধ বাবা সিদ্ধান্ত নেন, সে বিবাহ করবে।কিন্তু তার দুই সন্তান এবং সন্তানের বউ তাকে বিয়ে দিতে রাজী নয়। কারণ ওয়ারিশ বাড়বে। নাছোড়বান্দা বাবা, বিয়ে সে করবেই; কারণ দুঃসময়ে তার দেখভালের প্রয়োজন রয়েছে। নারাজী সন্তানদ্বয়কে নানা কৌশলে রাজী করাতে না পেরে, এক প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নেই বৃদ্ধ বাবা। তবে ভাগ্যে কোন যুবতী মেয়ে জুটলো না। জুটলো এক বৃদ্ধা। এরপর আরও যা ঘটলো।’

এই দিনের পালায় দর্শকরা প্রাণ উজাড় করে হাসতে পেরেছে। উৎসবের উদ্বোধনী দিনে ২৩ এপ্রিল পরিবেশিত হয়েছে, দেবীগঞ্জের তৃপ্তি নাট্যগোষ্ঠীর হুলিরগান পেঁচক্যাটার সংসার, পালার কাহিনীও মজাদার, 'স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভালই চলছিল, নেই তাদের সন্তানাদি, অভাবি সংসারের স্বামী ঢাকায় কাম কাজ করে আয় রোজগার করবে বলে তার স্ত্রীকে জানাল। যেই কথা, সেই কাজ। সিদ্বান্ত হলো ঢাকায় যাবার, কিন্তু তার স্ত্রী সঙ্গে যাবার বায়না ধরলো, কিন্তু তাকে নিতে রাজী নয় স্বামী পেঁচকাটার। কারণ, তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। গ্রাম্য এক বাজারের মুড়ি কেনাবেঁচা করতো এক সুন্দরী- সুশ্রী যুবতী। তার রূপ-চেহারায় আকৃষ্ট পেঁচক্যাটার ঐ নারীর টানে ঢাকায় যাবার কথা বলে বাড়ি ছাড়ে। পরে মুড়ি বিক্রেতার সাথে মন দেওয়া নেওয়া। প্রেমের উসিলায় বিয়ে, এরপর বাড়ি ফেরা। একেতো অভাব, তারপর দুই বউয়ের সংসার, পেঁচক্যাটা নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লো, বউ থাকতে বিয়ে, সংসারের জ্বালা যন্ত্রনার নানা ঘটনা এই পালায় উঠে এসেছে।'

বৈশাখী লোকনাট্য উৎসবের সার্বিক সহযোগিতা করে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন। উদ্বোধন করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এস.এম.ইমাম রাজী টুলু। দেখা মিলেছে নতুন নতুন বিনোদন প্রেমি ব্যক্তিদের সাথে। নিয়মিত দেখেছি পঞ্চগড় জেলা কালচারাল অফিসার সৈয়দ জাকির, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ আক্তারুজ্জামান এবং দিশারা নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার মোঃ রফিকুল ইসলাম সরকারকে। দিনব্যাপী উৎসবের প্রতিটি পালায় হাজার দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিই প্রমাণ করেছে, পঞ্চগড়ের লোকজ পালার কদর, চাহিদা সেই আগের মতই আছে।

লেখক : নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test