E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

জন্ডিস রোগের ভুল চিকিৎসা নয় প্রতিরোধে ঘরোয়া সমাধান 

২০২৫ মে ০৭ ১৭:০১:৩০
জন্ডিস রোগের ভুল চিকিৎসা নয় প্রতিরোধে ঘরোয়া সমাধান 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জন্ডিস খুবই প্রচলিত অসুখ। প্রকৃত পক্ষে জন্ডিস কোনো রোগ নয়। জন্ডিস মানে যকৃতের প্রদাহ বা হেপাটাইটিস। এটি রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ মাত্র। জন্ডিস বলতে বুঝায়, লিভারের যেকোনো জটিলতার কারণে চোখ হলুদ হওয়া, প্রস্রাব হলুদ হওয়া, খাওয়ায় অরুচি, মুখগহ্বর হলুদ হওয়া এবং কারো কারোর ক্ষেত্রে চামড়া পর্যন্ত হলুদ হয়ে যাওয়া। এসবকে জন্ডিসের লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে জন্ডিস হওয়া মানে কিন্তু লিভার কোনা কোনাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হয়।এটা সত্যি বলা হয়েছে যে, পেটের ওপর নির্ভর করে সারা শরীর চলে এবংযদি শরীর ঠিক না থাকে তবে পুরো শরীর বিকৃত হয়ে যায়। তাই জন্য যদি পেটে কোন সমস্যা হলে তাহলে তার প্রভাব পড়ে মুখে। এবং পেটের হাজার সমস্যার মধ্যে অন্যতম হল জন্ডিস। রক্তে বিলরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জন্ডিস হয়। পাচনতন্ত্র দুর্বল হওয়া জন্ডিসের প্রধান কারণ। জন্ডিস রোগের প্রভাব শরীরে রক্ত তৈরিতে পড়ে, যার ফলে শরীরে রক্তের পরিমাণ কম হতে থাকে। এই রোগে যদি অবহেলা করেন তাহলেকালো জন্ডিস হয়ে যাবে, যার ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। সাধারণভাবে শরীরে বিলরুবিনের মাত্রা ০.২ থেকে ১.২ মিলিগ্রাম/ডিএল এর কম থাকে, কিন্তু যখন এটা ৩মিলিগ্রাম/ডিএল এর বেশি বেড়ে যায় তখন সেটি জন্ডিস রোগে পরিণত হয়। জন্ডিসের শুরুর দিকে এর লক্ষণ গুলি সেভাবে দেখা যায় না। যখন এই রোগ বাড়তে শুরু করে তখন রুগীর চোখ এবং নখ হলুদ হয়ে যায়। অন্যদিকে প্রস্রাবও হলুদ রঙের হয় এবং ঠিক ভাবে খাবার হজম হয় না। এছাড়াও শরীরের নানান পরিবর্তন ঘটে, যা দেখে জন্ডিসকে চিহ্নিত করা হয়।

জন্ডিসের লক্ষণ

* ত্বকের রঙ হলুদ হয়ে যাওয়া * ত্বক চটচটে হওয়া * চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া * পেট ব্যথা এবং জ্বলন অনুভব করা * বমি হওয়া * গা গোলানো * দুর্বলতা * মাথা ব্যাথা * ক্ষুধার্ত অনুভব না করা * অস্থিরতা

জন্ডিসের কারণ

* সংক্রমণ * লিভারে দুর্বলতা * শরীরের রক্তের অভাব * রাস্তার পাশে কাটা ফল এবং দূষিত খাবার খাওয়া

হলুদ ত্বকের লক্ষণ (জন্ডিস)

* ত্বকের হলুদ হওয়া: সবচেয়ে লক্ষণীয় লক্ষণ হল ত্বকের হলুদ বিবর্ণতা, মুখ থেকে শুরু করে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

* চোখের হলুদ হওয়া: চোখের সাদা অংশ (স্ক্লেরা)ও হলুদ হয়ে যেতে পারে।

* শ্লেষ্মা ঝিল্লির হলুদ হওয়া: হলুদ মাড়ি, মুখের ভিতরে এবং জিহ্বার নীচের দিকে প্রসারিত হতে পারে।

* গাঢ় প্রস্রাব: প্রস্রাব অতিরিক্ত বিলিরুবিনের উপস্থিতির কারণে গাঢ় বা বাদামী বর্ণ ধারণ করতে পারে।

* ফ্যাকাশে মল: অন্ত্রে পৌঁছানো বিলিরুবিনের অভাবের কারণে মল ফ্যাকাশে বা মাটির রঙের হতে পারে।

* চুলকানিযুক্ত ত্বক: জন্ডিসে আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ত্বকে পিত্ত লবণ জমার কারণে চুলকানি (প্রুরিটাস) হতে পারে।

* ক্লান্তি: জন্ডিস ক্লান্তি এবং দুর্বলতার অনুভূতির সাথে যুক্ত হতে পারে।

* পেটে ব্যথা: কিছু ক্ষেত্রে, ব্যক্তিরা পেটে ব্যথা অনুভব করতে পারে, বিশেষ করে যদি জন্ডিস পিত্তথলির পাথর বা অন্যান্য লিভার বা পিত্ত নালী সমস্যার কারণে হয়।

* বমি বমি ভাব এবং বমি: জন্ডিসের সাথে বমি বমি ভাব, বমি হওয়া এবং ক্ষুধা না লাগার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি লিভারের রোগ বা পিত্তনালীতে বাধার সাথে সম্পর্কিত হয়।

* ওজন হ্রাস: কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ওজন হ্রাস ঘটতে পারে, বিশেষ করে যদি জন্ডিস লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারের মতো গুরুতর অন্তর্নিহিত অবস্থার কারণে হয়।

হলুদ ত্বকের ঝুঁকির কারণ

* তীব্র লিভার প্রদাহ: এটি লিভারের সংমিশ্রণ এবং বিলিরুবিন উত্পাদন করার ক্ষমতাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে, যার ফলে বিলিরুবিন তৈরি হয়।

* পিত্ত নালীর প্রদাহ: এই অবস্থা পিত্ত নিঃসরণ এবং বিলিরুবিন নিঃসরণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, উভয়ই জন্ডিসে অবদান রাখে।

* পিত্তনালীতে বাধাঃ এই বাধা লিভারের জন্য বিলিরুবিন নির্মূল করা কঠিন করে তোলে।

* হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায়, তখন বিলিরুবিন উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

* গিলবার্ট সিন্ড্রোম: এই বংশগত রোগ পিত্ত স্রাব পরিচালনা করার জন্য এনজাইমগুলির ক্ষমতাকে আপস করে।

* কোলেস্টেসিস: এই অবস্থা লিভারে পিত্তের প্রবাহকে ব্যাহত করে, যার ফলে কনজুগেটেড বিলিরুবিনযুক্ত পিত্ত কিডনির মধ্য দিয়ে যায় না এবং পরিবর্তে লিভারে থেকে যায়।

জন্ডিসে উপযুক্ত খাদ্য

* পিঁয়াজ জন্ডিসের প্রতিকার হিসাবে খুব উপযোগী। পিঁয়াজকে টুকরো টুকরো করে কেটে তাতে গোলমরিচ গুঁড়ো, বিট নুন এবং লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে খান।

* তাজা মুলোর পাতা বেঁটে রস বের করে নিন এবং তা ছেঁকে পান করুন। এটি লিভারের দুর্বলতা কম করে, পেট পরিষ্কার করে এবং খিদেও বাড়ায়।

* জন্ডিস রোগের প্রতিকার হিসাবে টমেটোও খুব ভালো একটু উপায়। এক গ্লাস টমেটোর রসে স্বাদমত নুন এবং গোল মরিচ মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন। ধনের বীজকে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে দিন এবং সকালে উঠে সেই বীজ খান।

* আয়রন এবং ক্যালসিয়াম জন্ডিসের সাথে লড়াই করার জন্য খুব দরকারি। তাই এই দুই উপাদান যুক্ত ঘোল খেলে সুবিধা পাওয়া যাবে।

* পেঁপে খেলে এনজাইম অ্যালবুমিনের মাত্রা সঠিক থাকে।

* আখের রস পান করুন, এটি রক্তে অতিরিক্ত বিলিরুবিন পরিমাণ সঠিক করে দেয়।

* দই জন্ডিসের সাথে লড়াই করার জন্য উপযোগী। এর মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া, জন্ডিসকে বাড়তে দেয় না।

* রসুনের তিন থেকে চার খোয়া নিয়ে বেটে নিন এবং সেটিকে দুধে মিশিয়ে খান। এতে জন্ডিস রোগের ভিতর থেকে চিকিৎসা হয় এবং লিভারে শক্তি প্রদান করে।

* ছোলার ডাল রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিন। সকালে পানিটা ফেলে দিয়ে ডালের সাথে গুড় মিশিয়ে খান। কয়েকদিন ক্রমাগত এই প্রতিকারকে ব্যবহার করলে আপনি জন্ডিস থেকে রেহাই পেতে পারেন।

* জন্ডিসের রোগীকে গাজর এবং কপির রস সমপরিমাণে একটি গ্লাসে মিশিয়ে খাওয়ান। এই রস ক্রমাগত কয়েকদিন খেলে আপনি জন্ডিস থেকে রেহাই পেতে পারেন।

* লেবুর রস জন্ডিসের জন্য খুব উপকারী। জন্ডিসের রেগীকে ১৫থেকে২০ মিলি লেবুর রস দিনে দু থেকে তিন বার পান করান।

* তাজা ভেষজ রসের সাথে মধু মিশ্রিত করুন এবং প্রতিদিন পান করুন, এটি দুই থেকে তিন সপ্তাহে জন্ডিস নিরাময় করবে।

* নবজাত শিশুরও যদি জন্ডিসের লক্ষণ দেখা যায় তাহলে স্তন্যপান করানো মায়েদেরও সকালে উঠে এক গ্লাস টমেটোর রস খাওয়া দরকার।

সাবধানতা

* গরম জিনিস খাবেন না।

* বেশি চলাফেরা করবেন না এবং আরাম করবেন।

* এই রোগে লঙ্কা, মশালাদার খাবার, ময়দা, মিষ্টি, বিউলির ডাল এবং তৈলাক্ত কোন খাবার খাবেন।

* সহজে হজম হয়ে যায় এমন খাবার খাবেন।

ভুল চিকিৎসা নয়

জন্ডিস যেহেতু কোনো রোগ নয়, তাই এর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। ৭ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে গেলে জন্ডিস এমনিতেই সেরে যায়। এ সময়টাতে খুব বেশি করে দরকার বিশ্রাম। বলা যায় বিশ্রামই এ রোগের চিকিৎসা। ব্যথার ওষুধ যেমন: প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ঘুমের ওষুধসহ অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় ও কবিরাজি ওষুধ খাওয়া মোটেও উচিত নয়। এককথায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধই সেবন করা ঠিক না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকিটাই বেশি থাকে।

হোমিও সমাধান

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে গরমকালে জন্ডিস সহ যে কোন জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই। কেননা একসময় আমরা শুনতাম যক্ষা হলে রক্ষা নেই ,বর্তমানে শুনতে পাই যক্ষা ভাল হয়। এ সবকিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল। জন্ডিস চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত চিহ্ন এবং উপসর্গগুলি দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়।আর জন্ডিস রোগীদের লক্ষণের যেইসব ঔষধ প্রাথমিক ভাবে যেইসব ঔষধ আসতে পারে, ব্রাইয়োনিয়া, চেলিডিনাম, নাক্স ভোম, চায়না, মার্ক সল, আর্সেনিক আয়োড, হাইড্রাস, লেপ্টেন্ডা, লাইকো, মার্ক ডাল, সিয়ানোথাস, নেট্রাম সালফ, থুজা সহ অনেক মেডিসিন লক্ষনের উপর আসতে পারে, তাই অভিজ্ঞ হোমিওচিকিৎসক ছাড়া ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগ আরো জটিল আকারে পোঁছতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, জন্ডিস দেখা দিলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করা যাবে না। বিশেষত প্রচলিত কবিরাজি, হারবাল বা বনাজি ও তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক অথবা ঝাড়ানোর মাধ্যমের মতো চিকিৎসা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।এক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে হবে।

লেখক: চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test