E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সংকটে অন্তর্বর্তীকাল

ইউনুস সরকারের ব্যর্থতার ছায়া: অর্থনীতি, ব্যবসা, প্রশাসনসহ সবখানে ধ্বস

২০২৫ জুলাই ১১ ১৮:৩৯:০১
ইউনুস সরকারের ব্যর্থতার ছায়া: অর্থনীতি, ব্যবসা, প্রশাসনসহ সবখানে ধ্বস

দিলীপ চন্দ


"নীতির চেয়ে বাস্তবতা বড়। আর বাস্তবতার চেয়ে রাজনীতি বড় শক্তি।" ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অচলাবস্থায় গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়লে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে। এক বছর পার না হতেই এই সরকারকে ঘিরে জনমনে হতাশা ও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাব, বাস্তবধর্মী রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সংকট এবং ‘গ্লোবাল ব্র্যান্ড’ হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থ প্রয়াস—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবকাঠামো এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংকটে পড়ে।

অর্থনীতি: ঋণ, রিজার্ভ, মুদ্রানীতিতে বিশৃঙ্খলা

সরকারের প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অর্থনীতিতে নেমে আসে এক বিপর্যয়।

রিজার্ভ পতন: ২০২৪ সালের শেষে রিজার্ভ যেখানে ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার, তা ২০২৫ সালের জুনে এসে নেমে আসে ২৮.৭ বিলিয়নে (বাংলাদেশ ব্যাংক)।

বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নতুন FDI প্রবাহ ৪২% হ্রাস পায় (বিডার পরিসংখ্যান)।

মূল্যস্ফীতি: বাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম হঠাৎ বাড়তে থাকে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা দমনে ব্যর্থ হয় সরকার। জুন ২০২৫ এ মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ১০.৩%।

অর্থনীতিবিদ সাইফুল আজিম মনে করেন, "একজন ব্যাংকারের হাতে বাজার তুলে দিলে লাভ-ক্ষতির হিসাব থাকে, মানবিক চাপ অনুপস্থিত থাকে।"

ব্যবসা ও বাণিজ্য: স্থবিরতার ধাক্কা

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ও আমলাতান্ত্রিক গতি প্রতিবন্ধকতা বাণিজ্যখাতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

পোর্ট ম্যানেজমেন্টে অচলাবস্থা: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পণ্য খালাসে দীর্ঘ বিলম্ব হয়। একাধিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং চুক্তি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত থাকে।

রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত: তৈরি পোশাক খাতে অর্ডার কমেছে প্রায় ২১%। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা স্থিতিশীলতা না থাকায় বিকল্প বাজারে মুখ ফেরায়।

ব্যবসায়ী নেতাদের অসন্তোষ: FBCCI, MCCI ও বিজিএমইএ একাধিকবার প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

"নীতির অনিশ্চয়তা ব্যবসার সবচেয়ে বড় শত্রু। আর এই সরকার আমাদের অনিশ্চয়তার সাগরে ফেলেছে।" বলে গণমাধ্যমে এমন মন্তব্য করেন ব্যবসায়ী নেতা সালমান ফিরোজ।

প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র: নেতৃত্ব শূন্যতার গর্তে

ড. ইউনুস রাজনৈতিক দলের বাইরে এসে একটি নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র দিয়ে সরকার চালানোর প্রয়াস নেন। কিন্তু এই ধারণা বাস্তবে দাঁড়ায় এক প্রশাসনিক পঙ্গুত্বে।

হাইপ্রোফাইল আমলারা দায়িত্ব নিতে অপারগ: কেউ কেউ ছুটিতে চলে যান, কেউ পদত্যাগ করেন। ফলে নীতিনির্ধারণে তৈরি হয় ভয়ানক শূন্যতা।

ফাইলচালনা বন্ধ: দপ্তরগুলো ‘সতর্কতার’ নামে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

মাঠ প্রশাসনে ভীতি: ডিসি, এসপি’রা রাজনৈতিক নির্দেশনা ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ থাকেন।

অবসরপ্রাপ্ত সচিব মনে করেন, "এটা রাজনৈতিক সরকার নয়, এটা একটা NGO mindset দিয়ে চালানো অফিস।"

রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা: জনবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন

ড. ইউনুস যে উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন, তা ছিল মূলত উপদেশ ও কল্পনা নির্ভর। জনতার সাথে তার সংযোগ ছিল দুর্বল, রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল উপেক্ষিত।

রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণহীনতা: আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে।

সামাজিক আন্দোলন বাড়ে: শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ প্রায় নিয়মিত রূপ নেয়।

নির্বাচনের রূপরেখা অনিশ্চিত

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা না থাকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ: আস্থার সংকেতহীন সরকার

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ পর্যায়ক্রমে একাধিকবার উদ্বেগ জানায় নির্বাচন-সংক্রান্ত অগ্রগতির অভাব নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ‘গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ’ না থাকায় বাণিজ্য সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি দেয়। এদিকে "একজন নোবেলজয়ী যদি রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা বুঝতে না পারেন, তাহলে তিনি আন্তর্জাতিক ফোরামে মুখ দেখাবেন কীভাবে?" শিরোনামে মে মাসে প্রতিবেদন ছাপেনিউ ইয়র্ক টাইমস।

উত্তরণের পথ কোথায়?

অন্তর্বর্তী ইউনুস সরকারের প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—শুধু আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায় না। জনভিত্তিক রাজনৈতিক বোঝাপড়া, বাস্তব নীতিনির্ধারণ, ও প্রশাসনিক দক্ষতা ছাড়া উন্নয়নের কল্পনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।

বিশ্লেষক ফারহানা হক বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডকে "সরকার নয়, একপ্রকার সামাজিক পরীক্ষার ল্যাবে আমরা ঢুকেছিলাম" বলে মনে করেন।

এখন দেশের মানুষের প্রত্যাশা একটাই—গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের দ্রুত প্রতিষ্ঠা, যাতে নীতিগত স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test