E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

হত্যা, ভাঙচুর, ধর্ষণ ও লুটপাটের মহোৎসব 

অন্তর্বর্তীকালীন ইউনুস সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের ক্রান্তিকাল

২০২৫ জুলাই ১৩ ১৭:১৯:১৯
অন্তর্বর্তীকালীন ইউনুস সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের ক্রান্তিকাল

দিলীপ কুমার চন্দ


২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতা, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রফেসর ইউনুস। এই সরকার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বাস্তবতা এক নির্মম বিপর্যয়ের গল্প বলছে।

সর্বত্রই যেন অরাজকতা, সহিংসতা, দখল, বিচারহীনতা ও সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয়। এই সময়কালেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি খুন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক দমন–পীড়ন এবং চাঁদাবাজি ঘটেছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত।

অপরাধের চিত্র

গত ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে ৬ জুলাই ২০২৫, এই ১১ মাসের বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপরাধের ধরন অনুযায়ী রাজনৈতিক হত্যা ও প্রতিশোধমূলক খুন বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার বিচার হয়নি। অপরদিকে ভাঙচুর ও দখলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের অফিস, মন্দির-মাদ্রাসাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা বিগত শাসনামলের চেয়ে অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে প্রতিদিন বাজার, পরিবহন ও নির্মাণ খাতে ভয়ানকভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এবং লুটপাট ও দস্যুতার হার বিগত দিনের তুলনায় অধিক মাত্রায় হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ অনুপস্থিত ও প্রশাসন নির্বিকার অবস্থানে রয়েছে।

ইউনুস সরকারের সময় কী ঘটেছে?

১. নির্বাহী শূন্যতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা: ইউনুস সরকার ‘নিরপেক্ষ’ ট্যাগ নিয়ে এলেও বাস্তবে দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ছিল অচল ও দ্বিধান্বিত। পুলিশ, র‌্যাব, জনপ্রশাসন—কারও মধ্যেই ছিল না কার্যকর নেতৃত্ব। ফলে অপরাধীরা সুযোগ বুঝে খুন, ধর্ষণ, দখল, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়।

২. রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার হয় সাধারণ মানুষ: আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দাঙ্গা-সংঘাতে শুধু রাজনীতিবিদ নয়, পুড়েছে সাধারণ মানুষের দোকান, বসতঘর, এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়। প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হয়েছে শত শত পরিবার।

৩. আইনের শাসন ভেঙে পড়া: বিচারব্যবস্থায় ছিল অস্থিরতা ও পক্ষপাতিত্ব। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা স্থগিত বা ধামাচাপা পড়ে যায়। ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, দখলবাজি—সব অপরাধেই বেড়ে যায় ‘ছাড়’ পাওয়ার প্রবণতা।

৪. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা: এই সময়কালে হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপরে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু এলাকায় রাম নাম লেখা কাগজ পুড়িয়ে দিয়ে ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার।

৫. মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও দমনপীড়ন: ইউনুস সরকারের সময় কিছু মিডিয়া হাউস বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের হুমকি ও হেফাজতের খবর পাওয়া যায়। ফলে সত্য প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

ঘটনার কয়েকটি দৃষ্টান্ত

ফরিদপুর (নভেম্বর ২০২৪): আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত, ৩৫টি বাড়ি ভাঙচুর।

কক্সবাজার (জানুয়ারি ২০২৫): রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাঁদাবাজ গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ১২, ধর্ষণের অভিযোগ ৪টি।

রাজশাহী (মার্চ ২০২৫): এক রাতেই ৪টি দোকানে আগুন, চাঁদা না দেওয়ায় লুটপাট।

ঢাকা (এপ্রিল ২০২৫): বিক্ষোভ দমনে পুলিশের গুলিতে নিহত ৩, গণগ্রেফতার ৫০+।

সুনামগঞ্জ (মে ২০২৫): হিন্দু পল্লীতে হামলা, মন্দির ভাঙচুর, প্রশাসন নিষ্ক্রিয়।

এই ক্রান্তিকাল থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?

১. অবিলম্বে একটি শক্তিশালী নির্বাচিত সরকার গঠন: দেশকে স্থিতিশীল করতে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে গঠিত সরকার অপরিহার্য। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

২. আইনের শাসনের বাস্তবায়ন: সব অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ ভাঙতে হবে।

৩. রাজনীতিকে অপরাধমুক্ত করা: দলীয় স্বার্থে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দলীয়ভাবে অপরাধমুক্তির সংকল্প নিতে হবে।

৪. স্বাধীন ও কার্যকর প্রশাসন: জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে দল-মত নির্বিশেষে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে।

৫. সাংবাদিকতা ও নাগরিক সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া: সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সত্য উন্মোচনে বাঁধা দিলে সমাজ অন্ধকারেই থেকে যাবে।

৬. নৈতিক শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা: স্কুল-কলেজে নৈতিকতা, মানবিকতা ও আইনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

ইউনুস সরকারের অন্তর্বর্তী শাসনকালে বাংলাদেশ এক গভীর নৈতিক ও সামাজিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। অপরাধ, সহিংসতা ও চরম অনিশ্চয়তা মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই সময়—এই সংকট থেকে উত্তরণের সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার। নইলে পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিশাপ দিয়ে যাব।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৯ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test