E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা: রাজনৈতিক আত্মঘাত ছাড়া আর কিছু নয়

২০২৫ আগস্ট ০২ ১৭:৪১:৫১
আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা: রাজনৈতিক আত্মঘাত ছাড়া আর কিছু নয়

আবীর আহাদ


বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা খবর ছড়িয়ে পড়ছে যে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ প্রবাসে একটা সরকার গঠন করতে যাচ্ছে! কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রবাসে সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই বলে আমার মনে হয়। বরং এ ধরনের চিন্তা একদিকে যেমন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের নিদর্শন, অন্যদিকে আত্মঘাতী কৌশলের প্রতীক। যারা এই ভাবনার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চাইছেন, তারা হয় বাস্তবতা অস্বীকার করছেন, নয়তো দলটিকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক পরাজয়ের আত্মস্বীকৃতি

প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা যে এক ধরনের রাজনৈতিক পরাজয়ের স্বীকৃতি, তা অনুধাবনে বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। ১৯৭১ সালের মতো যদি দেশ বিদেশি দখলে থাকত, যদি দেশের ভেতরে গণপ্রতিনিধিত্বশীল কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত—তাহলে হয়তো এমন একটি পদক্ষেপ কিছুটা যৌক্তিকতা পেত। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেই বাস্তবতা নেই।

আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে টিকে আছে, যদিও তাদের নেতৃত্ব দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন। প্রবাসে তথাকথিত ‘সরকার’ গঠন মানে হবে নিজেদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পরাজয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয়া।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: এক ধরনের অলীক কল্পনা

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি প্রবাসী সরকার তখনই গ্রহণযোগ্যতা পায়, যখন— ১) দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে বা মানবাধিকারের চরম বিপর্যয় রয়েছে, ২) একেবারে জনবিচ্ছিন্ন কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারের শাসন চলছে কিংবা বিদেশি দখলদার শাসন কায়েম হয়েছে, ৩) অন্তত একটি বা একাধিক পরাশক্তির সক্রিয় সমর্থন রয়েছে।

আওয়ামী লীগ এই তিনটি শর্তের একটিও পূরণ করে না। উপরন্তু, গত এক দশকে দুর্নীতি, লুটপাট, গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও ভোটাধিকার হরণের অভিযোগে দলটির নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক মহলে অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দিত হয়ে উঠেছে। সুতরাং তাদের প্রবাসী সরকারকে দেশবাসী বা বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দেবে- এটি নিছক রাজনৈতিক অলীক কল্পনা।

ভারতের ভূমিকায় অস্বস্তির নতুন ইতিহাস

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০% মুসলমান। এদের অধিকাংশই প্রকৃতগত ভারতবিরোধী ও চরম সাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তারা ভারতকে দেশের শত্রুজ্ঞান করে। সেই ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগ একটি প্রবাসী সরকার গঠন করলে এদেশের কট্টর মুসলমান তো বটেই, পাশাপাশি সেই মুহূর্তে ১৯৭১ সালের স্মৃতি জেগে উঠবে এবং বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্ব—ভারতের এ ভূমিকাকে অত্যন্ত বিরূপভাবে দেখবে। তারা একত্র হয়ে আবার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা’ বলে প্রচার চালাবে। পাকিস্তানের দিক থেকে তো তীব্র প্রতিক্রিয়া আসবে, কারণ তাদের জাতীয় মানসিকতা এখনও ১৯৭১-এর পরাজয়ের জ্বালায় পোড়া।

এই পরিস্থিতিতে ভারত একা কি সেই রিস্ক নিতে সাহস পাবে? বড় প্রশ্ন। যদি রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িত না থাকত, তাহলে তারা হয়তো ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের কারণে ভারতের পাশে এসে দাঁড়াতো এবং পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের অনুকূলে কিছুটা যেতে পারতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো- বর্তমানে রাশিয়া ব্যস্ত, চীন প্রতিপক্ষ, যুক্তরাষ্ট্র বিরূপ, মুসলিম বিশ্ব নীরব, আর ভারত একা।

সর্বশেষ, যদি শেখ হাসিনা এই রাজনৈতিক দুঃসাহসিক পদক্ষেপে যান, তবে তার অবস্থা পরিণত হবে এক ফলাফলহীন “দালাইলামা” সদৃশ এক নির্বাসিত নেতায়----যার কণ্ঠস্বর থাকবে, কিন্তু কার্যকারিতা থাকবে না।

জনগণ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার রসদ

প্রবাসে বসে কাগুজে মন্ত্রিসভা গঠন করলে দেশের সাধারণ মানুষ সেটিকে কীভাবে দেখবে? নিঃসন্দেহে এটি রাজনৈতিক পালিয়ে যাওয়া, ভণ্ডামি এবং জনগণকে ছেড়ে দূরে সরে যাওয়ার প্রকাশ হিসেবেই বিবেচিত হবে। মানুষ চায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুঃসময়ে মাঠে থাকুক, ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াক। কিন্তু যখন দেখা যাবে, নেতৃত্ব বিদেশে গিয়ে ‘ছায়া সরকার’ খেলছে—তখন সেটি শুধু হাস্যরসের উপকরণ হবে না, বরং ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানেরও কারণ হবে।

ইতিহাসের জঘন্য অপব্যবহার

আওয়ামী লীগ যদি ১৯৭১ সালের মুজিবনগর সরকারের উদাহরণ টেনে বর্তমান উদ্যোগকে বৈধতা দিতে চায়, তবে তা হবে ইতিহাসের জঘন্য অপব্যবহার। মুজিবনগর সরকার ছিল এক অনন্য প্রেক্ষাপটের অবধারিত পরিণতি—দেশ তখন দখলদার বাহিনীর কবলে, বঙ্গবন্ধু বন্দি, এবং মুক্তিযুদ্ধ চলমান। নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রজ্ঞা ও জনপ্রিয়তার প্রতীক, আর বাস্তব-কার্যকর প্রশাসনে ছিলেন সততা, সাহস ও দূরদৃষ্টির মূর্ত প্রতীক তাজউদ্দিন আহমদ। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ছিল প্রশ্নাতীত।

কিন্তু শেখ হাসিনা সে মানের নেত্রী নন। বরং তাঁর নেতৃত্ব দুর্নীতি, দমননীতি, আত্মমোহ ও বাস্তব বিচ্ছিন্নতার পরিচায়ক। ফলে তাঁর নেতৃত্বে প্রবাসে ‘ছায়া সরকার’ দেশবাসীর আস্থা ও সমর্থন পাবে—এমন ধারণা অবাস্তব ও বিভ্রান্তিকর।

সামরিক শক্তি ছাড়া প্রবাসী সরকার তামাশা

প্রবাসে সরকার গঠন করতে হলে আওয়ামী লীগকে একটি সংগঠিত, প্রস্তুত ও সক্রিয় সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে,যা বাস্তবতাবর্জিত এবং সম্পূর্ণ অসম্ভব। উপরন্তু, দেশের সাধারণ মানুষও এই ধরনের সিদ্ধান্তকে রাষ্ট্রবিরোধী ও আত্মঘাতী হিসেবে দেখবে, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করবে।

দলীয় পতনের অন্তর্গত কারণ

আওয়ামী লীগের আজকের পরিস্থিতির জন্য বাইরের ষড়যন্ত্র যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী দলীয় অভ্যন্তরের লোভ, লুণ্ঠন ও আদর্শচ্যুতি।

দুর্নীতি ও দখলদারিত্ব: রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ব্যাংক, প্রকল্প—সবই চলে গিয়েছিলো দলীয় সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। বিদেশে অর্থ পাচারের সীমা অতিক্রম করে গেলেও নেতৃত্ব ছিলো নীরব!

রাজাকারের পুনর্বাসন: যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদেরও আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অংশীদার করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান না করা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের নামে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানো এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের যথাযথ মূল্যায়ন না করাসহ দলীয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দিয়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে।

ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন: মূলত সংগ্রামীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী ও দালালচক্রের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে।

ফলত আজ দলটি মাঠে নেই, আন্দোলনে নেই, জনসম্পৃক্ততাও হারিয়ে ফেলেছে।

রাজনৈতিক পুনর্জন্মের একমাত্র পথ

আওয়ামী লীগের সামনে টিকে থাকার একমাত্র পথ: নেতৃত্বের শুদ্ধিকরণ ও পুনর্বিন্যাস, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া, তৃণমূলে সাংগঠনিক ভিত্তি পুনর্গঠন,
গণমানুষের সঙ্গে সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

এই কার্যকর ও নৈতিক পথ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে ‘ছায়া সরকার’ গঠনের মানে রাজনৈতিক আত্মহননের পথে হাঁটা।

বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা রাজনৈতিক আত্মঘাত ও দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ। এটি তাদের গণভিত্তিকে আরও দুর্বল করবে এবং দলটিকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠেলে দেবে। তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না—আওয়ামী লীগ এক সময় ছিল জাতির মুক্তির প্রতীক, অবকাঠামো ও উন্নয়নের রূপকার। সেই গৌরব তখনই সম্মান পাবে, যখন দলটি আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের ভুল স্বীকার করে আবার জনগণের মাঝে ফিরে আসবে।

অতএব, প্রবাস নয়, বাস্তবতা হোক তাদের রাজনৈতিক জীবনের মূলমন্ত্র। নইলে তারা এক সময়ের গৌরবময় দল হিসেবে ইতিহাসের পাদপ্রদীপ থেকে হারিয়ে যাবে- নিঃশব্দে ও নিঃস্বভাবে!

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০২ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test