E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মহান মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা

২০২৫ আগস্ট ০৬ ১৭:২৮:১৫
মহান মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা

আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের এক অনন্য ও গৌরবময় অধ্যায়, যা কেবল সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল এক জাতির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম, গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদার দাবিতে ঐতিহাসিক রক্তাক্ত অভ্যুত্থান।

এই যুদ্ধের দর্শন ও বাস্তবতা নির্ভর করে বহুস্তরীয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, যার শেকড় ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, এবং ১৯৭০-এর নির্বাচন পর্যন্ত বিস্তৃত।

দর্শনের ভিত্তি: জাতিসত্তা, অধিকার ও গণতন্ত্র

১. ভাষা ও জাতিসত্তা: ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন: “Urdu, and only Urdu, shall be the state language of Pakistan.”(সূত্র: পাকিস্তান গণপরিষদ ভাষণ, ১৯৪৮)

এই ঘোষণা বাঙালি জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে। এর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার শহীদ হন। এই আন্দোলনই ভবিষ্যতের মুক্তিযুদ্ধের বীজ রোপণ করে।

২. অর্থনৈতিক বৈষম্য: ১৯৪৮-১৯৭১ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানি আয় দিত মোট জাতীয় রপ্তানির ৫৫–৬০%, অথচ বাজেট বরাদ্দ পেত মাত্র ২৫–৩০%।

(সূত্র: Dr. Rehman Sobhan, “The Crisis of External Dependence”, 1974)

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা দাবির অন্যতম ছিল করব্যবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রা, বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব বণ্টনের অধিকার। এই ছয় দফা ছিল এক অর্থে ‘স্বাধীনতার রূপরেখা’।
(সূত্র: আবীর আহাদ, "বঙ্গবন্ধু: কারাজীবন সংগ্রাম স্বাধীনতা", ১৯৯৪ )

৩. গণতান্ত্রিক অস্বীকৃতি: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনের মধ্যে ১৬০টিই জয়লাভ করে, যা ছিল জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

“The Awami League had won a clear mandate. The West Pakistani leadership's refusal to transfer power was an open denial of democracy.”
—— Richard Sisson & Leo Rose, “War and Secession: Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh”

ঐতিহাসিক বাস্তবতা: দমননীতি ও গণহত্যা

● অপারেশন সার্চলাইট: ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালায়। শুধু ঢাকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিহত হন আনুমানিক ৭০০-১২০০ মানুষ।
(সূত্র: “Witness to Surrender” by Siddiq Salik)

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক R.J. Rummel গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা হিসেব করেন ৩ মিলিয়ন।
(সূত্র: Rummel, “Statistics of Democide”, 1997)

“This was no civil war; it was genocide.”
—— Indira Gandhi, Indian PM, 1971 (UN speech)

নারী নির্যাতন ও শরণার্থী সংকট

ধর্ষণের শিকার নারী: আনুমানিক ২ লক্ষ – ৪ লক্ষ
(সূত্র: Brownmiller, “Against Our Will”, 1975)

শরণার্থী সংখ্যা: ১ কোটির ঊর্ধে (ভারতে)।
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত: প্রায় ২.৫ কোটি।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দলিল: জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর 'Concert for Bangladesh' আয়োজন করেন নিউইয়র্কে, ১ আগস্ট ১৯৭১—যেখানে বিশ্ব গণমাধ্যম প্রথম বড় আকারে সংকটকে তুলে ধরে।

The New York Times (27 March 1971) শিরোনাম দেয় “Pakistani Troops Kill Unarmed Students in Dhaka”

Soviet Union ও ভারত ১৯৭১ সালের Friendship Treaty সই করে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষ নেয়।
(সূত্র: Indo-Soviet Treaty of Peace, Friendship and Cooperation, August 1971)

স্বাধীনতার দৃষ্টিভঙ্গি ও সংবিধান: ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চার মূল দর্শন অন্তর্ভুক্ত হয়:

১। গণতন্ত্র

২। সমাজতন্ত্র

৩। ধর্মনিরপেক্ষতা

৪। জাতীয়তাবাদ

এসব দর্শনের সমন্বিত চেতনাকে অনেক বিজ্ঞজন "মুজিববাদ" বলে আখ্যায়িত করেন।

“We declare that it shall be a fundamental aim of the State to realize a society free from exploitation of man by man.”
—— বাংলাদেশ সংবিধান, ধারা ১০

দর্শন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধের দর্শন কেবল অতীত ইতিহাস নয়- এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বিচারহীনতা, সন্ত্রাস ও সামাজিক বৈষম্য সেই দর্শনের ওপর আঘাত হানছে।

নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাসচর্চা, বস্তুনিষ্ঠ দলিলপত্র পাঠ, এবং মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ঘটনার নাম নয়, এটি একটি দর্শন, একটি আদর্শ এবং একটি মানবিক চেতনার যাত্রা, যা আবহমানকালীন গতিপথে অব্যাহত থাকতে হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৬ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test