E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

৭২-এর সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার অর্থ মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে অস্বীকার ও পাকিস্তানের পুনর্জাগরণ

২০২৫ আগস্ট ০৭ ১৭:৪৯:৪০
৭২-এর সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার অর্থ মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে অস্বীকার ও পাকিস্তানের পুনর্জাগরণ

আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল কেবল একটি ভূগোলভিত্তিক স্বাধীনতার ঘোষণা নয়, বরং ছিল একটি যুগান্তকারী আদর্শিক বিপ্লবের বাস্তবায়ন। এই বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি ও বাঙালি জাতিসত্তার নিধনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ। এরই সংবিধানিক রূপ ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান—যা একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথনির্দেশ করে। সেই সংবিধানকে মহলবিশেষ ছুঁড়ে ফেলতে চায়! তারা কি জানে না, এর অর্থ: মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে অস্বীকার ও পাকিস্তানের পুনর্জাগরণ? ৭২ এর সংবিধান কীভাবে এলো, তার ঐতিহাসিক সংগ্রামের দার্শনিক প্রেক্ষাপট নিম্নে তুলে ধরা হলো।

ঐতিহাসিক পটভূমি: পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈপরীত্যে বাঙালি স্বপ্ন

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল তথাকথিত "দ্বি-জাতি তত্ত্ব"-এর ভিত্তিতে, যেখানে ধর্ম ছিল রাষ্ট্রগঠনের প্রধান উপাদান। কিন্তু এই ভিত্তি ছিল সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ববাংলার প্রতি যে দমনমূলক, শোষণমূলক ও অসম আচরণ শুরু করেছিল, তা বাঙালির মধ্যে বঞ্চনা, ক্ষোভ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলে।

ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-৫২), ১৯৬২'র শিক্ষা-সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৮'র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯), ৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, এবং অবশেষে ৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির আন্দোলন একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় বিপ্লবে রূপ নেয়। এই বিপ্লবের আদর্শিক ও রাজনৈতিক ফসল ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান।

দার্শনিক ভিত্তি: সংবিধানের চার মূলনীতির অন্তর্নিহিত ভাবনা

৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের কাঠামো। প্রতিটি নীতির পেছনে রয়েছে একটি দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং বাস্তব সংগ্রামের পটভূমি:

১. গণতন্ত্র: এটি ছিল জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আমল থেকেই উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বীজ বপিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই ধারাকে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৭২ সালের সংবিধান সেই গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ—যেখানে জনগণ হবে রাষ্ট্রের মালিক, শাসকগোষ্ঠী নয়।

২. সমাজতন্ত্র: স্বাধীনতা অর্জনের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। পূর্ব পাকিস্তান ছিল আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে একটি শ্রেণিহীন সমাজ, কর্মজীবী মানুষের মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।

৩. ধর্মনিরপেক্ষতা: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে—এ ছিল এক মৌলিক অঙ্গীকার। পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে ধর্মকে শাসনের হাতিয়ার বানিয়েছিল, ৭২-এর সংবিধান সেখানে ধর্মীয় বিভাজনের বিপরীতে সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিল।

৪. বাঙালি জাতীয়তাবাদ: এই নীতি জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের সরাসরি প্রতিবাদ হিসেবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ভূগোলের ওপর। এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়ের জাগরণ, যা পাকিস্তানি চাপিয়ে দেওয়া উর্দুভাষাভিত্তিক ও ধর্মীয় জাতিসত্তার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে।

৭২-এর সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার অন্তর্নিহিত অর্থ: রাষ্ট্রীয় আত্মঘাত

আজ যারা ৭২-এর সংবিধানের মূল চার নীতিকে বাতিল করার অপচেষ্টা চালায়, তারা কেবল একটি দলিলকে অস্বীকার করে না, তারা অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির আত্মত্যাগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই।

এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা, কারণ:

রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে আবার সামনে আনা হচ্ছে।

বহুত্ববাদী ও সহনশীল সমাজের বদলে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভাজনমূলক মনোভাব।

সামরিক শক্তির প্রশ্রয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকছে রাষ্ট্র।

মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে বিকৃতি ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে।

এতদ্বারা আদতে আবারও সেই পাকিস্তানি ধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে—যা একবার পরাজিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়ের চিত্র: আজকের বাস্তবতায় ৭২-এর চেতনার প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান সময়ে বিচারহীনতা, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রযন্ত্রের দলীয়করণ, এবং ধর্মান্ধ রাজনীতির উত্থান—সবই এই মূল দর্শন থেকে বিচ্যুতির পরিণতি। যে সংবিধান ছিল একটি নৈতিক ভিত্তি, তা আজ হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের সুবিধা অনুযায়ী সংশোধনযোগ্য কাগুজে দলিল মাত্র।

বিশেষত, ১৯৭৭ ও ১৯৮৮ সালের সামরিক সংশোধনীগুলো সংবিধানকে তার মূল দর্শন থেকে ছিটকে দিয়েছে। ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংযোজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী, যা রাষ্ট্রকে আবার ধর্মীয় ভিত্তির দিকে ঠেলে দেয়।

নতুন জাতীয় ঐক্যের ডাক

আজ প্রয়োজন—একটি নতুন জাতীয় ঐক্য, একটি গণজাগরণ, একটি নৈতিক ও আদর্শিক পুনর্জাগরণ—যা ৭২-এর সংবিধানের মূল দর্শনকে পুনরায় রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করবে।

৭২-এর সংবিধান কেবল আইনগত দলিল নয়, এটি বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের নৈতিক ভিত্তি। এই ভিত্তিকে ধ্বংস করার যে কোনো প্রচেষ্টা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খাটো করা।

আজ যারা এই চেতনাকে খণ্ডিত করতে চায়, তারা ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। এবং এই জাতি, যারা একদিন রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিল, তারা প্রয়োজনে আবারও আত্মোৎসর্গে পিছপা হবে না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৭ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test