E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সত্য প্রকাশের পথে বিপদ 

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও তার নিরাপত্তা

২০২৫ আগস্ট ১০ ১৮:১৪:৪১
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও তার নিরাপত্তা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


সাংবাদিকতা একটি মহৎ ও দায়িত্বপূর্ণ পেশা। সমাজের অব্যবস্থা, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধের বিরুদ্ধে তথ্য-ভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করে সাংবাদিকরা সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকেন। তবে এই পেশায় জড়িতদের জন্য রয়েছে নানান রকম হুমকি ও ঝুঁকি। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও অধিকাংশ ঘটনায় বিচার হয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশকে দিন দিন আরও বিপদজনক করে তুলছে।

সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের ধরন

১. শারীরিক নির্যাতন: রিপোর্ট করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক মারধর, অপহরণ বা হত্যার শিকার হন।

২. মানসিক নির্যাতন ও হুমকি: ভয়ভীতি দেখানো, হুমকিমূলক ফোন, গোপন নজরদারি এবং সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়।

৩. আইনি হয়রানি: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা আইনের অপপ্রয়োগ করে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়।

৪. চাকরি হারানো: চাপের মুখে সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয় বা পেশা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের বাস্তবতা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও চাপ বাড়ছে, যার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ড: নৃশংসতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত

২০২৫ সালের ৭ আগস্ট গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকায় স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। তিনি তার ফেসবুক লাইভে স্থানীয় চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরেন, যার কারণে একটি সংঘবদ্ধ চক্র তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড গোটা দেশে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (BMSF) এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা এই হত্যার কঠোর নিন্দা জানায়। ঘটনার পর ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তবে বিচার প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে থেমে যাবে তা নিয়ে রয়েছে আশঙ্কা। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা।

সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের নিদারুণ অভিজ্ঞতা

কক্সবাজারের সাংবাদিক ও সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা খান ২০১৯ সালে পুলিশের ঘুষ ও মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ে সংবাদ প্রকাশের কারণে তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও তার সহযোগীদের রোষানলে পড়েন। তাকে ঢাকায় গ্রেফতার করে কক্সবাজারে এনে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ৬টি সাজানো মামলা, যেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া এখনো ঝুলে আছে। তিনি প্রায় ১১ মাস কারাভোগ করেন এবং জামিনে মুক্ত হলেও এখনো মিথ্যা মামলাগুলো থেকে মুক্তি পাননি।

তার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদনও আটকে আছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স না দেওয়ার অজুহাতে, যা একেবারে আইনের ব্যত্যয়। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি পিবিআই, যা বিচারব্যবস্থার প্রতি চরম অবহেলার নিদর্শন।

ফরিদুল ও তার পরিবার বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন, আর্থিক ও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ নিঃস্ব। তিনি ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সহায়তার আবেদন জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছেন।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: সাংবাদিক নির্যাতনের বিচারহীনতার প্রতীক

সাংবাদিক নির্যাতনের সবচেয়ে আলোচিত, বেদনাদায়ক ও বিচারহীন একটি ঘটনা হলো সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাসায় নির্মমভাবে খুন হন এই দুই সাংবাদিক। সেসময় সরকার দ্রুত বিচার ও দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও দীর্ঘ ১৩ বছরেও তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় পিছিয়েছে ৮৫ বারেরও বেশি।

এই দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতা পুরো সাংবাদিক সমাজে হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতার বাতাবরণ তৈরি করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার না হওয়া মানে হলো—একটি ভয়ঙ্কর বার্তা দেওয়া যে, সাংবাদিকদের হত্যা করেও পার পাওয়া যায়।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড আজও সাংবাদিকদের ওপর আস্থাহীনতা, ভয়ের পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদি তখন দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতো, তাহলে হয়তো গাজীপুরের তুহিন হত্যার মতো ঘটনা ঘটতো না।

সাংবাদিক নির্যাতনের পেছনের কারণসমূহ

১. রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা: সাংবাদিকরা যখন প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দুর্নীতি উন্মোচন করেন, তখন তারা টার্গেটে পরিণত হন।

২. দুর্বল আইন প্রয়োগ ও বিচার বিলম্ব: আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, পক্ষপাত ও বিলম্বিত তদন্ত বিচারহীনতাকে উৎসাহিত করে।

৩. দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কাঠামো: তদন্তকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় অপরাধীদের পক্ষ নেয়, যার ফলে নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে।

৪. গণমাধ্যমের নিজস্ব প্রতিরক্ষা দুর্বলতা: অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই তাদের সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ায় না, বা চাপের মুখে নীরব থাকে।

করণীয়: সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কী করা প্রয়োজন

১. আইনি সংস্কার ও কঠোর প্রয়োগ: সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলাদা আইন প্রণয়ন ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন জরুরি।

২. নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত ব্যবস্থা: সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।

৩. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বন্ধ: সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এ আইনের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

৪. সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ: আত্মরক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত।

৫. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরদারি ও চাপ: জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর মত সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, সাংবাদিকতা একটি জাতির আয়না। সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরার মাধ্যমে এটি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যখন সাংবাদিকরা নির্যাতন, মামলা, হয়রানি এবং হত্যার শিকার হন, তখন সেই আয়নাটি ভেঙে যায়। সমাজের সামনে সত্য প্রকাশের পথ বন্ধ হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে। গাজীপুরে মো. আসাদুজ্জামান তুহিনের নির্মম হত্যাকাণ্ড, ফরিদুল মোস্তফা খানের পৈশাচিক নির্যাতন ও হয়রানি, এবং সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘদিন ধরে চলা বিচারহীনতা—এই সবই প্রমাণ করে দেয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জন্য কাজের পরিবেশ আজ গভীর সঙ্কটে।

নতুন সরকার বারবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবতায় সাংবাদিক নির্যাতন, মামলা এবং হুমকির ঘটনা কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

এটি শুধু সাংবাদিকদের সমস্যা নয়, এটি দেশের গণতন্ত্রের উপর সরাসরি আঘাত। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে প্রয়োজন রাষ্ট্রের সব শাখার আন্তরিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ। সরকারকে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন সাংবাদিকরা নিরাপদে নিজেদের কাজ করতে পারেন।

প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত কার্যক্রম চালাতে হবে। বিচার বিভাগকে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় বিচারহীনতা বন্ধ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও সাংবাদিকদের প্রতি সমর্থন ও সুরক্ষা দিতে সচেতন হতে হবে।

অন্যথায়, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সাংবাদিকতার ভূমিকাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। সত্য প্রকাশের শেষ আশ্রয় হারিয়ে যাবে, এবং সমাজের নানান সমস্যা অন্ধকারে ঢেকে থাকবে। সেজন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নির্ভয়ে এবং সাহসের সঙ্গে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরতে পারেন।

তাই গাজীপুরে তুহিনের হত্যাকাণ্ড, কক্সবাজারে ফরিদুল মোস্তফার নির্যাতন কিংবা রাজধানীতে সাগর-রুনির বিচারহীন হত্যা—এগুলো শুধুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এগুলো আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি কঠোর সতর্কবার্তা। এখনই যদি কার্যকর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

সাংবাদিকতা শুধুমাত্র তথ্য সংবাদের মাধ্যম নয়, এটি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি। যখনই সত্যের কণ্ঠ নীরব হয়ে যায়, তখনই অন্যায়, দুর্নীতি ও অবিচার বেড়ে যায়। তাই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা শুধু তাদের পেশাগত অধিকার নয়, এটি দেশের সর্বস্তরের মানুষের অধিকার এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি রক্ষা করার অন্যতম প্রধান শর্ত।

আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো সাংবাদিকদের প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা। আন্তর্জাতিক মহলকেও আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, যেন কোনো দেশের সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচিত হয় এবং প্রভাবিত হয় নীতিনির্ধারকরা।

যতদিন পর্যন্ত সাংবাদিকরা মুক্তভাবে কাজ করতে পারবেন না, ততদিন পর্যন্ত সত্যের পথে আমাদের লড়াই অসম্পূর্ণ থাকবে। তাই আসুন, একসঙ্গে হাতে হাত রেখে সাংবাদিকতার সুরক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য কাজ করি,যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরা সত্য প্রকাশের এই বাতিঘর থেকে আলোকিত হতে পারে।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

১০ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test