E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিশ্ব মানবতা দিবস

বৈশ্বিক সংকটে সহমর্মিতার নতুন অঙ্গীকার

২০২৫ আগস্ট ১৯ ১৭:৩০:৫৪
বৈশ্বিক সংকটে সহমর্মিতার নতুন অঙ্গীকার

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ মঙ্গলবার ১৯ আগস্ট সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব মানবতা দিবস ২০২৫। ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট বাগদাদে জাতিসংঘ কার্যালয়ে ভয়াবহ হামলায় ২২ জন মানবিক কর্মী নিহত হওয়ার পর জাতিসংঘ এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তাদের ত্যাগ স্মরণ করেই ২০০৯ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

২০২৫ সালে এসে দিবসটির তাৎপর্য আরও গভীর হয়েছে। কেননা এ বছর মানবিক সংকট পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলে এক নতুন মাত্রা নিয়েছে—দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, জলবায়ু বিপর্যয়, শরণার্থী সঙ্কট—সব মিলিয়ে মানবতা যেন সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখে। জাতিসংঘের এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য —“বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন অর্থাৎ, সংকট মোকাবেলায় শুধু বাইরের সাহায্য নয়, স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও সক্ষমতাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ অভিজ্ঞতা বলছে, স্থানীয়রাই প্রথম সাড়া দেন এবং দীর্ঘমেয়াদে পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দেন।

২০২৫ সালের বিশ্ব মানবতা দিবসের গুরুত্ব

বিশ্ব মানবতা দিবস ২০২৫ শুধু স্মরণ ও উদযাপনের জন্য নয়, বরং মানবিক সহায়তার গুরুত্বকে আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে আনে। এ বছরের প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংঘাত, দুর্ভিক্ষ, জলবায়ু পরিবর্তন ও শরণার্থী সঙ্কট বিশ্বব্যাপী মানুষকে বিপর্যস্ত করেছে।

১. মানবিক কর্মীদের ত্যাগ স্মরণ করানো: এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবিক কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয় পৌঁছে দেন। গাজা, সুদান ও ইউক্রেনের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে তাদের ত্যাগ বিশেষভাবে মূল্যবান। তাদের সাহস এবং আত্মত্যাগ বিশ্ব মানবতার প্রেরণা।

২. সংকটগ্রস্ত মানুষের কষ্ট সামনে আনা: বিশ্ব মানবতা দিবস সচেতনতা বাড়ায়—যেসব মানুষ খাদ্য, পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে ভুগছেন, তাদের কষ্টকে বিশ্ববাসীর নজরে আনে। এটি আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারক ও মিডিয়াকে এই সমস্যা সমাধানে প্রভাবিত করে।

৩. দাতাদের সহায়তায় উৎসাহিত করা: এই দিনটি দাতা দেশ, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিকে মানবিক সহায়তায় অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সঠিক তহবিল নিশ্চিত হলে লাখ লাখ মানুষের জীবন পরিবর্তিত হতে পারে।

৪. সাধারণ মানুষকে মানবিক উদ্যোগে যুক্ত করা: এটি সাধারণ মানুষকে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার প্রেরণা দেয়। খাদ্য বিতরণ, শিক্ষাসেবা বা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অংশগ্রহণ—সবই মানবিক প্রভাব বাড়ায়।

৫. আন্তর্জাতিক সংহতি ও সহযোগিতার বার্তা: বিশ্ব মানবতা দিবস ২০২৫ প্রমাণ করে, মানবিক সংকট শুধুমাত্র একটি দেশের সমস্যা নয়। এটি আন্তর্জাতিক সংহতি এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।

৬. দীর্ঘমেয়াদী মানবিক পরিকল্পনার গুরুত্ব: এ দিনটি মানুষকে মনে করায়—মানবিক সহায়তা শুধু জরুরি সাহায্য নয়, বরং পুনর্গঠন ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের অংশ। স্থানীয় সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উদ্যোগের গুরুত্ব এখানে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়।

মানবিক কর্মীদের ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা

* মানবিক সহায়তা দেওয়া আজকের দিনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর একটি।

* ২০২৪ সালে মানবিক সহায়তাকর্মী নিরাপত্তা তথ্যভাণ্ডার–এর তথ্যমতে ৮১৬টি আক্রমণ ঘটে, যেখানে ৩৮৩ জন নিহত হন।

* শুধু গাজাতেই ২০২৪ সালে ১৭৫ জন মানবিক কর্মী নিহত হয়েছেন, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন (সূত্র: জাতিসংঘ মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় - UNOCHA, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড)

* ২০২৫ সালের প্রথমার্ধেই বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় ১৫০-এর বেশি কর্মী নিহত হয়েছেন।

এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়—মানবিক কর্মীরা আর শুধু সেবা দানকারী নন, তারা নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে আশার আলো জ্বালান।

বৈশ্বিক মানবিক চাহিদা ২০২৫

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩০৫ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।এদের মধ্যে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মানুষকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অর্থের ঘাটতির কারণে প্রায় ১১৫ মিলিয়ন মানুষ সহায়তার বাইরে থেকে যাবে। এটি শুধু সংখ্যার হিসাব নয়—এর মানে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু খাবার পাবে না, অসংখ্য পরিবার আশ্রয়হীন হবে এবং অসংখ্য মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হবে।

তহবিল সংকট: মানবিকতার সামনে বড় বাধা

জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমের জন্য ২০২৫ সালে ৪৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু বছরের প্রথম দিকে পাওয়া গেছে মাত্র ৫% তহবিল। ২০২৪ সালের মতো এবারও অনেক বড় দাতা দেশ বাজেট সংকোচন করছে। এর ফলাফল ভয়াবহ: সিরিয়ায় খাদ্য সহায়তা ৮০% কেটে দেওয়া হয়েছে। কঙ্গো ও ইয়েমেনে লক্ষ লক্ষ পরিবার ত্রাণের অভাবে দিন কাটাচ্ছে। সুদানে ও গাজায় পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

এই ঘাটতি পূরণে জাতিসংঘকে জরুরি তহবিল থেকে ১১০ মিলিয়ন ডলার মুক্ত করতে হয়েছে (সূত্র: রয়টার্স, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস)। কিন্তু সেটি সমাধান নয়, কেবল সাময়িক সান্ত্বনা।

সংকটপূর্ণ অঞ্চলের করুণ চিত্র

গাজা উপত্যকা

* ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত গাজায় ৬৬,০০০ শিশু গুরুতর পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

* মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৮০০-এর বেশি মানুষ সহায়তা কেন্দ্রেই নিহত হয়েছেন ত্রাণ সংগ্রহের সময় সংঘটিত হামলায়।

* হাসপাতাল ও খাদ্যগুদামে হামলার কারণে সাধারণ মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে।

সুদান

* চলমান যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে ৫ লক্ষাধিক শিশু প্রাণ হারিয়েছে বলে ইউনিসেফ সতর্ক করেছে।

* লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।

* চিকিৎসা কেন্দ্র, খাদ্য ভাণ্ডার ও পানীয় জলের সরবরাহ ধ্বংসপ্রাপ্ত।

অন্যান্য অঞ্চল

* ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান থাকায় লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত।

* আফগানিস্তানে ভূমিকম্প ও খরার কারণে সহায়তার চাহিদা বেড়েছে।

* কঙ্গো ও সোমালিয়ায় সংঘাত–ক্ষুধা একসাথে দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে।

মানবিক কাজের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

১. নিরাপত্তাহীনতা: মানবিক কর্মীরা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে হামলা, অপহরণ এবং লক্ষ্যবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। গাজা, সুদান, ইয়েমেন ও ইউক্রেনের মতো এলাকায় এমন ঘটনা বারবার ঘটছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে সহায়তা কার্যক্রম ধীর হয়, এবং অনেকসময় সাহায্য প্রয়োজনীয় মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় না।

২. তহবিল ঘাটতি: বিশ্বব্যাপী মানুষের মানবিক চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু দাতাদের তহবিল কমছে। ২০২৫ সালের জন্য প্রয়োজন ৪৭ বিলিয়ন ডলার হলেও, বছরের শুরুতে মাত্র ৫% তহবিলই পাওয়া গেছে। তহবিল সংকটের কারণে খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় ও শিক্ষাসহ মৌলিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক সংস্থা কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হচ্ছে।

৩. জলবায়ু পরিবর্তন: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং তাপপ্রবাহ মানবিক বিপর্যয়কে তীব্র করছে। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ও পানীয় জলের সংকট বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষ দুর্ভিক্ষ, পানি-সংকট এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। মানবিক কর্মীদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে, কারণ তহবিল ও নিরাপত্তা সীমিত।

৪. রাজনৈতিক বাধা: অনেক অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হচ্ছে স্থানীয় বা জাতীয় নীতি, সীমানা অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে। সংস্থাগুলোকে অনুমোদন, ভিসা, প্রবেশাধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সময় ও সংস্থান ব্যয় করতে হচ্ছে। এর ফলে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।

৫. জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও স্থায়ী বাস্তুচ্যুত সমস্যা: যেখানে যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্থায়ীভাবে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, সেখানে সহায়তার চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন উদ্বাস্তু শিবির তৈরি করতে হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে ওঠে।

৬. প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ও যোগাযোগ সংকট: দুর্গম এলাকায় ডিজিটাল প্রযুক্তি সীমিত থাকায় সহায়তা কার্যক্রম পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কঠিন হয়। তথ্যের অভাবে সহায়তা সঠিকভাবে পৌঁছানো, বিপদ সংকেত শনাক্ত করা এবং কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়।

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্ব মানবতা দিবস ২০২৫ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—মানবিকতার মাপকাঠি কেবল সাহায্যের পরিমাণ নয়, বরং সহমর্মিতা, ন্যায্যতা ও দায়িত্ববোধের মধ্যে নিহিত। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো শুধু দাতাদের দায়িত্ব নয়, এটি মানব সভ্যতার টিকে থাকার শর্তও বটে।

আজ পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তহবিল সংকট, রাজনৈতিক বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে এদের অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। মানবিক কর্মীরা নিজের জীবন বিপন্ন করে গাজা, সুদান বা ইউক্রেনের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছেন। তাদের এই ত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবতা সীমান্ত, জাতি কিংবা ধর্ম মানে না।

এ কারণে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত পদক্ষেপ। বৈশ্বিক দাতাদের উচিত তহবিল বৃদ্ধি করা, যাতে খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় বঞ্চিত মানুষের কাছে পৌঁছায়। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যাতে তারা সংকট মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিতে পারে। মানবিক কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও আজ সময়ের দাবি।

যদি বিশ্ব একসাথে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে, তবে বর্তমানের ক্ষুধা, কষ্ট ও অসহায়তা একদিন মানবতার জয়ে রূপ নেবে। তখন পৃথিবী সত্যিই শান্তি, সহমর্মিতা ও ন্যায়ের আলোয় আলোকিত হবে—যেখানে প্রতিটি ক্ষুধার্ত, অসহায় ও দুর্বল মানুষের কাছে মানবতার স্পর্শ পৌঁছে যাবে।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

১৯ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test