E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বাংলাদেশ কোন পথে: অরাজকতার অন্ধকারে, নাকি মুক্তির আলোর পথে?

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৩ ১৭:৪১:৫২
বাংলাদেশ কোন পথে: অরাজকতার অন্ধকারে, নাকি মুক্তির আলোর পথে?

আবীর আহাদ


আজকের বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। একদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণফসল, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও উন্নয়নের সম্ভাবনা; অন্যদিকে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ইতিহাস বিকৃতি এবং পরাধীনতার আশঙ্কা। রাষ্ট্রের আকাশে জমেছে দুর্যোগের কালো মেঘ। এই মেঘ কেবল অর্থনীতির আকাশেই নয়—রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে ছায়া ফেলেছে। তাই প্রশ্ন উঠছে: বাংলাদেশ কোন পথে যাচ্ছে?

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবমাননা: জাতির আত্মপরিচয়ের সংকট

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয় গড়ে উঠেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মহত্ত্বের ওপর। অথচ আজ সেই ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, শহীদ পরিবারকে অবহেলা—এসব কেবল অতীত বিস্মৃতির বিষয় নয়; এগুলো জাতির আত্মপরিচয় ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। যে জাতি নিজের ইতিহাস ভুলে যায়, সে ভবিষ্যতের পথও হারিয়ে ফেলে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক অব্যবস্থা

স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও অর্থনীতি বৈষম্যে ভরপুর। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে দম বন্ধ করা অবস্থায় ফেলেছে। কর্মসংস্থানের সংকটে শিক্ষিত তরুণরা হতাশ। কৃষক ন্যায্য দাম পায় না, শ্রমিক শোষিত হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অবহেলিত; শহর-গ্রামের বৈষম্য প্রকট। দুর্নীতি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে যে মানুষের আস্থা ভেঙে পড়েছে। তার উপর বৈদেশিক ঋণ ও আমদানি-নির্ভরতা আত্মনির্ভরশীলতাকে ক্রমশ গ্রাস করছে।

আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্য

আইনের শাসন দুর্বল হলে রাষ্ট্রের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়। আজ বাংলাদেশে সেই চিত্র সুস্পষ্ট। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, মব-সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, যপ্রতিপক্ষ দমন এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নারী ও শিশু ক্রমেই নিরাপত্তাহীন। সাধারণ নাগরিক বুঝে গেছে—রাষ্ট্র তাকে আর রক্ষা করতে পারছে না।

ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তির উত্থান: স্বাধীনতার শত্রু পুনরুত্থিত

১৯৭১ সালে যারা পরাজিত হয়েছিল, তারা আজ নানা ছদ্মবেশে ফিরে আসছে। ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজে বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো তাদের মূল কৌশল। আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গেও তারা যুক্ত হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচরিত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এই শক্তি দমন করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস হবে এবং বাংলাদেশ তার স্বাধীনতাই হারাবে।

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হুমকি

বিশ্বরাজনীতির প্রতিযোগিতায় আমেরিকা, চীন, ভারত ও রাশিয়া—সবাই বাংলাদেশকে কৌশলগত কারণে টানাটানি করছে। দুর্বল নীতি ও অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাংলাদেশ খেলোয়াড় হতে না পেরে অনেক সময় “খেলার মাঠে” পরিণত হয়।

উদ্বেগজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি স্বার্থনির্ভর প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপের মুখে দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বিদেশি শক্তির হাতে তুলে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এমন সমঝোতা কেবল সম্পদই নয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করে। একটি দুর্বল রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

জনগণের ঐতিহাসিক ভূমিকা

বাংলাদেশের শক্তি হলো তার জনগণ। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন—প্রতিটি সংকটই জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অতিক্রম করেছে। আজও সেই জনগণের ঐক্যই হতে পারে মুক্তির পথ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা শিক্ষা, প্রযুক্তি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছে, তারাই ভবিষ্যতের আশার প্রতীক।

উত্তরণের আলোকরেখা

সংকট যতই গভীর হোক, বাংলাদেশের সম্ভাবনা অশেষ। উত্তরণের জন্য জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু প্রণীত রাষ্ট্রীয় আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, আইনের শাসন, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা।

বাংলাদেশ আজ দ্বিমুখী সড়কে দাঁড়িয়ে। একদিকে অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার অন্ধকার; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আত্মমর্যাদা, গণতন্ত্র, সক্ষমতা ও উন্নয়নের আলো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—বাংলাদেশ বারবার অন্ধকার ভেদ করেছে। তাই আজও আশা করা যায়, জনগণের ঐক্য, বাঙালি জাতিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবারো দেশকে মুক্তির আলোর পথে নিয়ে যাবে।

প্রশ্ন শুধু একটাই: আমরা কি সেই আলোর পথে হাঁটার সাহস দেখাবো?

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test