E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পাঁচ দশকের শিক্ষা অগ্রযাত্রা, শতভাগ সাক্ষরতার সোপান এখনও দূরে

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৭ ১৭:৪৩:২৬
পাঁচ দশকের শিক্ষা অগ্রযাত্রা, শতভাগ সাক্ষরতার সোপান এখনও দূরে

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আগামীকাল সোমবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে “আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৫”। ১৯৬৭ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এবং ১৯৭২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদ্‌যাপন হচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হলো সাক্ষরতা অর্জন করা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাক্ষরতার সংজ্ঞা ভিন্ন হলেও, ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো সর্বজনীন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। তখন শুধু নাম লিখতে পারলেই মানুষকে সাক্ষর বলা হতো। পরবর্তীতে প্রায় প্রতি দশকে সংজ্ঞায় পরিবর্তন আসে। ১৯৯৩ সালের সংজ্ঞা অনুযায়ী, একজনকে সাক্ষর হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়:১) নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারা, ২) নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারা, ৩) দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারা।

স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাক্ষরতা

মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে। সাক্ষরতা এবং উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। নিরক্ষরতা উন্নয়নের অন্তরায়। টেকসই সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও দক্ষতা, যা সাক্ষরতার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়েও শতভাগ সাক্ষরতার মাইলফলক ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৭ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে এখনও ২৩.২% নিরক্ষর, অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৫৭ লাখ, নারী ও পুরুষ সমান প্রায় ৮ কোটি ৭৮ লাখ। শিশু (০–১৪ বছর) প্রায় ২৮%, কর্মক্ষম বয়স (১৫–৬৪) ৬৬%, বৃদ্ধি (৬৫+) ৭%। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৪৮ লাখ।

সাক্ষরতার অর্জন ও অগ্রগতি

স্বাধীনতার পর প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সাক্ষরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয় প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি। মেয়েদের উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন—সবই সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

২০১১ সালে সাক্ষরতার হার: ৫১.৭৭% ২০২২ সালে: ৭৪.৬৬% ২০২৫ সালে: প্রায় ৭৬.৮%
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সংখ্যাগত বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, বরং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত কেবল মৌলিক দক্ষতা অর্জন নয়, বরং নৈতিকতা, মূল্যবোধ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশ।

কতজন নিরক্ষর?

২০২৫ সালে ৭ বছরের বেশি বয়সী জনগণের মধ্যে প্রায় ২৩% মানুষ নিরক্ষর। বয়সভিত্তিক হার: ৭–১৪ বছর: ৭৩% ১৫–৪৫ বছর: ৭৩.৬৯% এটি বোঝায় যে দেশের বড় অংশ এখনও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি প্রয়োজন, যাতে নিরক্ষররা মৌলিক ও আধুনিক সাক্ষরতা অর্জন করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ, ভোক্তা শিক্ষা ও জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

শহর ও গ্রামে পার্থক্য

শহরাঞ্চলে সাক্ষরতার হার: ৮১.৪৫% গ্রামাঞ্চলে: ৭১.৬৮%। পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬.৭১%, নারীদের ৭২.৯৪%। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সাক্ষরতায় তৃতীয় স্থানে এবং ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।

শহর ও গ্রামের পার্থক্য কমানোর জন্য শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ও প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি অপরিহার্য।

সাক্ষরতা ও যুগোপযোগী চ্যালেঞ্জসমূহ

* ডিজিটাল সাক্ষরতা : আধুনিক যুগে সাক্ষরতার মান কেবল পড়া-লিখা নয়; প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটে দক্ষতা অর্জনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ, অনলাইন নিরাপত্তা, তথ্য যাচাই এবং সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। শিশু, কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করা হলে তারা তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে এবং সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে না। ডিজিটাল সাক্ষরতা থাকলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক চাকরি ও ব্যবসায় আরও সক্ষম হবে।

* কর্মসংস্থান ও দক্ষতা: সাক্ষর মানুষ শুধু শিক্ষিতই নয়, কর্মক্ষম ও দক্ষও হয়। এটি চাকরি এবং ব্যবসায় উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি করে। দক্ষ জনশক্তি না থাকায় বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি সীমিত হয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা, জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং ভোক্তা শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। হাতে কলমে প্রশিক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীর দক্ষতা উন্নয়নে কার্যকর।

* বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ : প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিশেষ পাঠ্যক্রম, সহায়ক শিক্ষক এবং উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করলে তারা সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠী আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে এবং সমৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়।

* প্রান্তিক জনগোষ্ঠী : চা–শ্রমিক, পাহাড়ি, ভাসমান ও নদীভাঙনকবলিত মানুষ এখনও শিক্ষার বাইরে। তাদের মূলধারায় আনতে চলন্ত স্কুল, কমিউনিটি শিক্ষা কেন্দ্র এবং বিশেষ শিক্ষামূলক প্রকল্প প্রয়োজন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হলে দেশের মানবসম্পদ আরও শক্তিশালী হবে এবং সমাজে সমতার চেতনা বৃদ্ধি পাবে।

* অভিবাসী শ্রমিক ও প্রবাসী : প্রবাসী ও অভিবাসী শ্রমিকদের মৌলিক সাক্ষরতা এবং ভাষা শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে তারা বিদেশে আরও অর্থনৈতিকভাবে সফল হবে এবং দেশের অর্থনীতি উন্নত হবে। অভিবাসীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করলে তাদের জীবনমান বৃদ্ধি পাবে এবং তারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

* নারী শিক্ষার চ্যালেঞ্জ : বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য এবং সামাজিক কুসংস্কার নারীদের শিক্ষায় বড় প্রতিবন্ধকতা। নারী শিক্ষার প্রসারে সামাজিক সচেতনতা, অর্থনৈতিক সহায়তা, উপবৃত্তি এবং কমিউনিটি উদ্যোগ অপরিহার্য। শিক্ষিত নারী কেবল নিজেকে নয়, পরিবার ও সমাজকেও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। নারীদের শিক্ষায় অবদান রাখলে দেশের মানবসম্পদ আরও শক্তিশালী হয়।

* গবেষণাহীন শিক্ষা : উচ্চশিক্ষা বর্তমানে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি মুখী হওয়ায় শিক্ষার্থীর বিষয়জ্ঞান সীমিত হয়ে গেছে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের গবেষণাভিত্তিক এবং বাস্তবমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নত করা সম্ভব।

* বেসরকারি উদ্যোগ : ব্র্যাক, গণশিক্ষা এবং অন্যান্য এনজিও শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং শিশুদের শিক্ষার আলোতে আনার জন্য এই ধরনের উদ্যোগ কার্যকর। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করলে শিক্ষার বিস্তৃতি ও মান আরও উন্নত হবে।

* পরিবেশ ও শিক্ষা : পরিবেশ সচেতনতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের শিক্ষা শিশুদের টেকসই জীবনধারার জন্য প্রস্তুত করে। শিক্ষার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং টেকসই সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।

* সমাজে শিক্ষার প্রভাব : শিক্ষা শুধু ব্যক্তির জন্য নয়, সমাজের শান্তি, সমৃদ্ধি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করে। শিক্ষিত নাগরিক দুর্নীতি কমায়, মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। শিক্ষার প্রসারে সামাজিক একতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

* অপরিকল্পিত উদ্যোগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ : ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে নেওয়া শিক্ষা নীতি এবং বাংলাদেশে কমিশনভিত্তিক পরিকল্পনা অনেকাংশে অপরিকল্পিত ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রশিক্ষণ অপ্রতুল থাকায় শ্রেণি পাঠদানে মানহ্রাস হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্প্রসারণ, কোর্স আধুনিকায়ন, শিক্ষক পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষার হার বাড়ছে, নিরক্ষর মানুষ পাচ্ছে শিক্ষার আলো। তবে এখন সময় এসেছে মানসম্মত ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করার। শিক্ষা হোক জীবনের জন্য। সাক্ষরতা হোক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির বাতিঘর। ঘরে ঘরে কলম, কাগজ ও বই হোক অগ্রগতির হাতিয়ার। সাক্ষরতা হোক আগামির বিশ্ব গড়ে তোলার দুর্বার শক্তি।শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও বৈষম্য কমানো সম্ভব। শিক্ষা হোক সমাজের নৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের ভিত্তি। দেশের প্রতিটি নাগরিক, বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রান্তিক ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক।শিক্ষা হোক জীবনমান উন্নয়নের মূল হাতিয়ার। সাক্ষরতা হোক শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের পথে অটুট পথপ্রদর্শক।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test