E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সাক্ষরতার আলো ও অন্ধকার: অগ্রগতির পথে বাংলাদেশ, তবু সতর্কবার্তা

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১০ ১৯:৪৫:১২
সাক্ষরতার আলো ও অন্ধকার: অগ্রগতির পথে বাংলাদেশ, তবু সতর্কবার্তা

ওয়াজেদুর রহমান কনক


প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ইউনেস্কো ১৯৬৬ সালে এ দিবসটির সূচনা করে এবং ১৯৬৭ সালে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয়। এর লক্ষ্য হলো সাক্ষরতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে এর ভূমিকা নতুনভাবে অনুধাবন করা।

৮ সেপ্টেম্বরের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের চিত্রটি একদিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির, অন্যদিকে তা এক কঠিন সতর্কবার্তাও বয়ে আনে। সরকারি স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (SVRS) ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে ৭ বছর বা তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার সার্বিক সাক্ষরতার হার দাঁড়িয়েছে ৭৭.৯%—এর মধ্যে পুরুষ ৮০.১% এবং নারী ৭৫.৮%। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘লিটারেসি অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে ২০২৩’ দেখায়, পরীক্ষাভিত্তিক কার্যকর (functional) সাক্ষরতার হার মাত্র ৬২.৯২%। অর্থাৎ পড়তে-লিখতে পারলেও দৈনন্দিন জীবনে জ্ঞান প্রয়োগের সক্ষমতায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।

সাক্ষরতার অগ্রগতি সত্ত্বেও নগর-গ্রাম বৈষম্য স্পষ্ট। ২০২২ সালের জনগণনা বলছে, নগরে সাক্ষরতার হার ৮১.৩%, গ্রামে ৭১.৬%। বিভাগভেদে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৭৮.০৯% সাক্ষরতার বিপরীতে ময়মনসিংহে সর্বনিম্ন ৬৭.০৯%। এ চিত্রে যুক্ত হয়েছে ঝরে পড়ার নতুন প্রবণতা। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.২৫%—ছেলেদের ১৪.৭% ও মেয়েদের ১৮%। করোনোত্তর শেখার ঘাটতি, অর্থনৈতিক চাপ এবং বিদ্যালয়ে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ এ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও সমান উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক (১৫+) সাক্ষরতার হার এখন প্রায় ৮৬% হলেও এখনও প্রায় ৭৩.৯ কোটি মানুষ মৌলিক সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত, যাদের দুই-তৃতীয়াংশ নারী। একই সঙ্গে অন্তত ২৫০–২৫১ মিলিয়ন শিশু-কিশোর স্কুলের বাইরে, আর যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের বিরাট অংশও যথাযথ দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মহামারির অভিঘাতে শেখার দারিদ্র্য বা লার্নিং পভার্টি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে—২০১৯ সালে যেখানে হার ছিল ৫৭%, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭০%।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল সাক্ষরতার চ্যালেঞ্জ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৫.৯৯ মিলিয়ন। সংযোগের এই বিপুল বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্য-বাছাইয়ের দক্ষতা, নিরাপদ ব্যবহার ও সমালোচনামূলক পড়ার ক্ষমতা অর্জন এখন সময়ের দাবি।

গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেলেও বৈষম্য রয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে বৈশ্বিক সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৬৮ শতাংশ, যা বর্তমানে বেড়ে ৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবুও ৭৩৯ থেকে ৭৫৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ মৌলিক পড়া-লেখায় অদক্ষ রয়ে গেছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠী বৈশ্বিক উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ২৭ কোটি শিশু ও কিশোর বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। একই সময়ে চার জনে একজন শিশু প্রাথমিক পাঠে দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। আরও ভয়াবহ হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৭৩ শতাংশ সাধারণ পাঠ্য বুঝতে অক্ষম—যা ‘লার্নিং পভার্টি’ নামে পরিচিত। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা ও উন্নয়নে গুরুতর সংকট তৈরি করছে।

সাক্ষরতায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এখনো দগদগে বাস্তবতা। বিশ্বব্যাপী সাক্ষরহীন প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নারী। দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও সাব-সাহেলি আফ্রিকার মতো অঞ্চলে এ বৈষম্য আরও প্রকট। বিশ্বের সাক্ষরহীন জনগোষ্ঠীর তিন-চতুর্থাংশই এই অঞ্চলে, এবং নারীরাই এর প্রধান ভুক্তভোগী।

ভৌগোলিক বৈষম্যও স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলোর সাক্ষরতার হার যেখানে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ, সেখানে দক্ষিণ সুদান, মালি কিংবা আফগানিস্তানের মতো দেশে তা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি নয়। এতে বোঝা যায়, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সঙ্গে সাক্ষরতার সম্পর্ক কতটা নিবিড়।

সাক্ষরতার সংজ্ঞা ও মাপঝোকেও বৈচিত্র্য রয়েছে। অনেক দেশে শুধুমাত্র পড়তে ও লিখতে পারাকেই সাক্ষরতা ধরা হয়। কোথাও আবার জরিপের মাধ্যমে, কোথাও সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা হয়। ইউনেস্কো সম্প্রতি GAML প্রকল্প চালু করেছে, যাতে দেশভেদে পরিসংখ্যানকে আরও নির্ভুল ও তুলনাযোগ্য করা যায়।

সাক্ষরতার প্রভাব গভীর ও বহুমাত্রিক। এটি দারিদ্র্য হ্রাস, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ও সামগ্রিক জীবনমান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষত নারী সাক্ষরতা বৃদ্ধি পরিবার ও সমাজের কল্যাণে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনে।

২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “ডিজিটাল যুগে সাক্ষরতা প্রসার।” এর মাধ্যমে শুধু প্রচলিত পড়া-লেখা নয়, বরং ডিজিটাল দক্ষতা, তথ্য বিশ্লেষণ এবং অনলাইনে নিরাপদ অংশগ্রহণের গুরুত্বও সামনে আনা হচ্ছে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সাক্ষরতা শুধু শিক্ষার অধিকার নয়, এটি টেকসই উন্নয়ন, নারী ক্ষমতায়ন ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের মৌলিক ভিত্তি। যদিও বৈশ্বিক গড় অগ্রগতির পথে, কিন্তু লিঙ্গ, ভৌগোলিক ও ডিজিটাল বিভাজনের কারণে কোটি কোটি মানুষ এখনো মূলধারার বাইরে। তাই ৮ সেপ্টেম্বর হয়ে ওঠে শুধু একটি দিবস নয়, বরং বৈশ্বিক দায়বদ্ধতার প্রতীক ও পরিবর্তনের দৃঢ় অঙ্গীকার।

বিশ্ব মানবতার অগ্রযাত্রায় শিক্ষা সর্বাধিক শক্তিশালী হাতিয়ার। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো ঘোষণা করে ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে। তখন থেকেই প্রতিবছর এ দিনে বিশ্বের দেশগুলো সাক্ষরতার বর্তমান চিত্র, অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে থাকে।

সর্বশেষ ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৭৭ কোটি মানুষ এখনও নিরক্ষর, যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী। সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ এখনও নিরক্ষরতার বোঝা বহন করছে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শিক্ষার বাইরে থাকা মানুষ কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ডিজিটাল রূপান্তরের যুগে যখন জ্ঞান অর্থনীতির দিকে বিশ্ব ধাবিত হচ্ছে, তখন সাক্ষরতা শুধু পড়া-লেখা শেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি হয়ে উঠেছে জীবিকা অর্জন, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা এবং বৈশ্বিক যোগাযোগের অপরিহার্য শর্ত।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টির গুরুত্ব আরও প্রবল। স্বাধীনতার পর দেশটিতে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। ধীরে ধীরে সরকার, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফলে এই হার বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৬.৮ শতাংশ। শহরে এই হার বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনও পিছিয়ে থাকা লক্ষণীয়। নারী শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হলেও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসতি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিরক্ষরতার হার এখনও উদ্বেগজনক।

সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবতায় নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। একদিকে শিশুশ্রম, অন্যদিকে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনও বেশ উচ্চ। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিশু আর বিদ্যালয়ে ফিরে যেতে পারেনি। এতে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাক্ষরতা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। শুধু পড়তে-লিখতে জানলেই হবে না, বরং তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করার দক্ষতাও সমানভাবে জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, আগামী দশকে কর্মসংস্থানের বড় একটি অংশ আসবে এমন খাতে যেখানে ডিজিটাল সাক্ষরতা অপরিহার্য। বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখতে হলে প্রাথমিক ও প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি ডিজিটাল সাক্ষরতা সম্প্রসারণ করতে হবে।

সাক্ষরতা কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত নয়, এটি সামাজিক মুক্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠারও অন্যতম হাতিয়ার। নিরক্ষর মানুষ সাধারণত দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বন্দী থেকে যায়। শিক্ষিত ব্যক্তি যেমন তার অধিকার বুঝতে ও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশে সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। বিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ উন্নয়ন, শিক্ষা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে নারীদের জন্য শিক্ষা সহজলভ্য করা গেলে সাক্ষরতার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস তাই কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন রূপরেখায় সাক্ষরতার গুরুত্ব নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর অক্ষরের আলোয় আলোকিত হওয়ার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন গতি পেয়েছে। তবে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে একসাথে কাজ করতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test