E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি-জামায়াত: সংবিধান ও রাজনৈতিক দর্শনের দ্বন্দ্ব

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২১ ১৭:৫৭:৪৪
আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি-জামায়াত: সংবিধান ও রাজনৈতিক দর্শনের দ্বন্দ্ব

আবীর আহাদ


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত দুটি বিপরীত দর্শনগত দ্বন্দ্বের ইতিহাস। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদাতা আওয়ামী লীগ, যারা রাষ্ট্রের জন্ম ও সংবিধানিক ভিত্তি গড়ে তোলে; অন্যদিকে বিএনপি–জামায়াত, যারা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সামরিক সংশোধনী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির প্রতিনিধি। এ দ্বন্দ্বকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে: “১৯৭২ সালের সংবিধান বনাম সামরিক সংশোধনী” অথবা “মুক্তিযুদ্ধ বনাম প্রতিক্রিয়াশীলতা।”

১. মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২ সালের সংবিধান

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ভূখণ্ডের জন্ম দেয়নি, দিয়েছে এক রাষ্ট্রদর্শন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (Proclamation of Independence, ১০ এপ্রিল ১৯৭১)¹ ঘোষণা করা হয়েছিল: বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র।

এই ঘোষণারই সাংবিধানিক রূপ ১৯৭২ সালের সংবিধান²। এতে চার মূলনীতি-

ক. জাতীয়তাবাদ

খ. গণতন্ত্র

গ. সমাজতন্ত্র (অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার)

ঘ. ধর্মনিরপেক্ষতা

সংরক্ষিত হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন সরাসরি এ চার নীতির সঙ্গে যুক্ত, যা রাষ্ট্রকে আধুনিকতা, অগ্রগতি ও মানবিক মর্যাদার পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল।

২. সামরিক শাসন ও প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দিক পরিবর্তিত হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান, ক্ষমতা দখলের পর পঞ্চম সংশোধনী³ (১৯৭৯) মাধ্যমে সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংযোজন করেন, রাষ্ট্রীয় আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বৈধতা দেন। ফলে জামায়াতে ইসলামীসহ যুদ্ধাপরাধী শক্তি রাজনীতিতে ফিরে আসে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনী⁴র মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন।

এ দুটি সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রদর্শনকে প্রতিক্রিয়াশীল ও পাকিস্তানমুখী ধারায় ফিরিয়ে আনে। বিএনপি ও জামায়াত এ সংশোধনীর ভেতর দিয়েই বৈধতা ও রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে।

৩. রাজনৈতিক দর্শনের দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশের রাজনীতি তাই দাঁড়িয়ে আছে দু'টি বিপরীত মেরুতে:

আওয়ামী লীগ: ১৯৭২ সালের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন রক্ষাকারী;

বিএনপি–জামায়াত: সামরিক সংশোধনী ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারার উত্তরাধিকারী।

ফলে বিএনপি–জামায়াতের রাজনীতি আসলে আওয়ামী লীগের বিপরীতে দাঁড়িয়েই অর্থপূর্ণ। আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ছাড়া তাদের পরিচয় ও বক্তব্য কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

৪. গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নাকি দার্শনিক বিরোধ?

সাধারণত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি–জামায়াত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়। এটি মূলত রাষ্ট্রের পরিচয়, আদর্শ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এক দার্শনিক সংঘাত।

আওয়ামী লীগ = মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্র।

বিএনপি–জামায়াত = প্রতিক্রিয়াশীলতা, সামরিক শাসন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র।

সুতরাং এটা স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ আছে বলেই বিএনপি–জামায়াতের অস্তিত্ব আছে। আওয়ামী লীগ যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, বিএনপি–জামায়াত সেখানে সেই চেতনার বিরোধিতার ভেতর দিয়ে টিকে আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির মৌল দ্বন্দ্ব তাই দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং “মুক্তিযুদ্ধ বনাম প্রতিক্রিয়াশীলতা” এবং “১৯৭২ সালের সংবিধান বনাম সামরিক সংশোধনী।”

লেখক :মুক্তিযেদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test