E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

জাতির মর্মমূল ৭১’র স্বাধীনতা স্মরণে

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৭ ১৭:২৭:০২
জাতির মর্মমূল ৭১’র স্বাধীনতা স্মরণে

চৌধুরী আবদুল হান্নান


“বর্তমান বাংলাদেশে মীর জাফর, জগৎ শেঠ আর উমিচাঁদের অভাব নেই। ইংরেজরা বিদেশ থেকে অর্থ লুট করে নিজ দেশে নিয়ে যেত আর আমাদের দেশের বিশ্বাসঘাতকরা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে।”

১৯৭২ সালে প্রতিটি জনসভায় বঙ্গবন্ধু যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে কথা বলতেন, বীরাঙ্গনা মায়েদের বলতেন, “তোমাদের শিশুর পিতার নাম কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলে দিও, তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আর ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২।”

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাঙালি নারীদের প্রতি দখলদার পাকসেনাদের মর্মন্তুদ নির্যাতনের ফলে যুদ্ধ শেষে বহু শিশুর জন্ম হয়েছিল, এ সকল যুদ্ধশিশুর পিতা নেই, মা বীরাঙ্গনা।

দেশ স্বাধীন হলো ঠিকই, কিন্ত তাদের জীবন আর মান সম্মান নিয়ে শুরু হলো নিরন্তর দুর্দশা, অবহেলা আর সামাজিক লাঞ্ছনা। অনেকেই পরিবারে তাদের আর গ্রহণ করেনি, সীমাহীন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা জাতির। এ নতুন মহাসংকটে হাত বাড়ালেন বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীনতার অব‍্যবহিত পরের দিনগুলোতে বিশ্বের কয়েকজন নেতা মন্তব‍্য করেছিলেন, ধনী দেশগুলোর সাহায‍্য ছাড়া এই নতুন দেশটি টিকে থাকতে পারবে না।

১৯৭৬ সালে বিশ্বব‍্যাংকের দু’জন শীর্ষ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যদি বাংলাদেশের মতো একটি দেশের উন্নতি ঘটে; তা হলে ধরে নিতে হবে বিশ্বের যে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারে। বাংলাদেশ নিয়ে কত যে অবহেলা আর বিদ্রুপ!

বাঙালিরা সব সময় অন‍্যের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে , তারা শাসক ছিল না।এখন আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের শাসন আমাদেরই হাতে। কিন্ত জন্ম লগ্ন থেকেই হিংসা আর নোংরা রাজনীতি চর্চায় চলে গেছে অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময়, নিরবিচ্ছিন্ন উন্নতির চিন্তা করবে কখন?

না চাহিতে যা পাওয়া যায় তার মূল‍্য থাকে না। স্বাধীনতার মর্ম বুঝে ওঠার আগেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এতো অল্প সময়ের যুদ্ধে বিশ্বের কোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জনের নজির নেই।

স্বাধীনতা পেতে কত মূল‍্য দিতে হয়, তা বুঝতে হলে দক্ষিণঁ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামের দিকে তাকাতে হবে। দেশটি এক সময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাদের জাতির পিতা কমরেড হো চি মিনের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৯ বছর ব‍্যাপী যুদ্ধের পর ফ্রান্স চরমভাবে পরাজিত হয়ে ভিয়েতনাম ছেড়ে যায়। কিন্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, এক সময় তারা ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, ২০ বছরের অধীক সময় ধরে চলা যুদ্ধে হত‍্যা করা হয় বিশ লক্ষাধীক ভিয়েতনামীকে। প্রবল পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৫ সালে যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে ভিয়েতনাম ছেড়ে যায়। এভাবে ভিয়েতনামীরা বুঝতে পেরেছে স্বাধীনতা পেতে কত মূল‍্য দিতে হয়!

ভিয়েতনামের জাতির পিতা হো চি মিন ১৯৭৫ সালে প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৯ পর্যন্ত (আমৃত‍্যু) দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি দেশ গড়ার সময় ও সুযোগ পেয়েছিলেন, ভিয়েতনামকে গড়ে দিয়েছেন।

‘৭৫ এর পর বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে মাঝিবিহীন নৌকার মতো, বিভিন্ন দল , মতের সমন্বয় ঘটাতে সমঝোতার উদ‍্যোগ নেওয়ার কোনো নেতার আগমণ ঘটেনি ।দেশ পরিচালনায়

অভ‍্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল ও বিবাদ প্রশমিত করে একযোগে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে সমঝোতার মানসিকতা থাকতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম‍্যান্ডেলা মৃত‍্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দীর্ঘ সময় পাড়ি দেওয়ার পর অবশেষে বিজয়ীর বেশে বেরিয়ে এসে তিনি অত‍্যাচারী স্বেতাঙ্গ শাসকদের সাথেও সমঝোতার পথে চলেছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের ডেমোক্র‍্যাটিক দলের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মহামন্দার বিপাকে পর্যদস্ত দেশটির সরকারে প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান দল থেকে দু’জন মন্ত্রী রেখেছিলেন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন মতের সাথে সমন্বয়ের মাধ‍্যমে কাজ করার এমন অনন‍্য নজির থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নেইনি।

এ দেশে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনাকালে ইংরেজরা বুঝে গিয়েছিল এই বাংলা লুটে নিতে চাইলে মীর জাফরের মতো লোকই তাদের দরকার।

বর্তমান বাংলাদেশে মীর জাফর, জগৎ শেঠ আর উমিচাঁদের অভাব নেই।ইংরেজরা বিদেশ থেকে অর্থ লুট করে নিজ দেশে নিয়ে যেত আর আমাদের দেশের বিশ্বাসঘাতকরা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে। গবেষণা বলছে , কেবল বিগত সরকারের আমলেই পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার। মূলত দেশের বৃহৎ শিল্প মালিকেরা রক্ষকদের সাথে আতাত করে ব‍্যাংক লুট করে অর্থ পাচার করেছে।

যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেলো, কেবল নিজের স্বার্থে ও দলীয় স্বার্থে কাজ করলো, দেশের কথা ভাবলো না, দুর্নীতির মাধ‍্যমে নিজের অর্থ ভান্ডার পূর্ণ করলো। এ জন‍্যই বলা হয়, ক্ষমতা মানেই দুর্নীতি, ক্ষমতার মাত্রা যত বেশি দুর্নীতি পরায়ণতা তত বেশি।

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন, “আমার কৃষক শ্রমিক দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি করে শিক্ষিত লোকেরা।”

“ধনী দেশগুলোর সাহায়‍্য ছাড়া এই দেশটি টিকে থাকতে পারবে না।”— সদ‍্য স্বাধীন দেশ সম্পর্কে ১৯৭২ সালে এমন অবজ্ঞাসূচক মন্তব‍্য এখন নতুন করে কানে বাজে।

বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়, ইমিগ্রেশনে বাড়তি জেরা করা হয়। জাল কাগজপত্র দিয়ে ভিসা আবেদন করার ঘটনাও ধরা পড়ার নজিরও কম নয়, অনেক দেশ তো বাঙালিদের ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে।

কী কারণে বাংলাদেশি পাসপোর্টে এজাতীয় সমস‍্যা হয়, এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমি কাউকে দোষ দিতে পারবো না।কারণ আমরাই আমাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছি , আমাদের ঘর গোছাতে হবে।”

আমাদের আত্মমর্যাদা বোধ কবে জাগ্রত হবে?

স্বার্থপর, প্রতারকের অভয়ারণ‍্য দেশটি ক্রমে বসবাসের অযোগ‍্য হওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই তাদের সন্তানদের বিদেশে স্থায়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। অনেক পরিবার রয়েছে যাদের সন্তানেরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে দেশে ফিরে আসেনি, বসবাসের জন‍্য বিদেশকেই বেছে নিয়েছে এবং পরবর্তীতে পরিবারের অন‍্যান‍্য সদস‍্যদের নিয়ে যাবে।

হিংসা আর প্রতিশোধের নোংরা রাজনীতিতে পার হয়ে গেছে দীর্ঘ সময়, দেশের কোনো অগ্রগতি না হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চাৎ গমন ঘটেছে।

এবার আঘাত এসেছে বাংলাদেশের মর্মমূল ‘৭১ এর স্বাধীনতায়। রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়া থেকে উদ্ধারের দরজা খুলে দিয়েছিল তরুণ শিক্ষার্থীরা, ছাত্র-জনতার প্রত‍্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্ত তাদের চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-স্মারক ভাঙচুর করে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালালো। যুদ্ধশিশুর ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২- ইতিহাসের অংশ সন্ত্রাস করে ভাঙলো, মব সৃষ্টি করে ইতিহাসের ওপর আক্রমণ।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেঙে দিলেও তাঁর অবদান, স্মৃতি বাঙালির হৃদয় থেকে কেউ মুছে দিতে পারবে না; বরং সময়ে আরও উজ্জ্বল হতে থাকবে।

ইতিহাস দেখিয়েছে, দূরদর্শি ব‍্যক্তি যাঁরা সময়ের আগেভাগে সত‍্য বলেন, জাতির কল‍্যানে সর্বস্ব বিলিয়ে দেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের করুণ পরিণতি দেখা গেছে। সক্রেটিসকে অন‍্যায়ভাবে মৃত‍্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগরকে শেষ জীবনে “সমাজপতিদের” বিরূপ আচরণে মানসিক কষ্টে তাঁর চিরচেনা শহর কোলকাতা থেকে দূরবর্তী ঝাড়খান্ডের একটি সাঁওতাল পল্লীতে একাকিত্ব বরণ করে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে বাধ‍্য হয়েছিলেন।

জাতির ক্রান্তিকালে আমাদের ভরসা দেশের সেনা বাহিনী, সম্প্রতি সেনা সদরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে- “মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ‍্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আগে আমরা যেভাবে সশ্রদ্ধ সালাম করেছি, আজও করি এবং ভবিষ‍্যতেও অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা ও সালাম করব। “মব” বা কোনো কিছু করে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করার কোনো সুযোগ নেই।”

দেশ প্রেমিক সেনা বাহিনীর এমন অবস্থান আমাদের আশার আলো দেখায়। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব‍্যাংক।

পাঠকের মতামত:

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test