E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বাংলাদেশের সমুদ্রযাত্রা

প্রান্ত থেকে বৈশ্বিক শক্তিতে যে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করে, তার হাতে ভবিষ্যৎ

২০২৫ অক্টোবর ০১ ০০:২৪:২১
প্রান্ত থেকে বৈশ্বিক শক্তিতে যে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করে, তার হাতে ভবিষ্যৎ

মো. ইমদাদুল হক সোহাগ  


বাংলাদেশের আগামী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান ক্রমেই নির্ভর করছে সমুদ্রের ওপর। অবকাঠামোগত সংযোগ কেবল ভৌগোলিক দূরত্ব কমায় না—এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে জাতীয় প্রবাহে যুক্ত করে, উৎপাদন ও বাজারে নতুন আস্থা যোগ করে। বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু এবং ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখিয়েছে, একটি সংযোগ অবকাঠামো মানুষের জীবন, ব্যবসা ও মানসিকতা বদলে দিতে পারে। সংযোগ মানেই নতুন সম্ভাবনা, নতুন শক্তি।

একটি রাস্তা, এক অঞ্চলের উল্টো স্রোত
ঝিনাইদহে স্কুলজীবনে আমি দেখেছি—দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকাগামী যানবাহন একসময় আমাদের উপজেলা দিয়েই যেত। বাজারে ভিড় থাকত, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি থাকত। কিন্তু মাগুরা হয়ে নতুন মহাসড়ক চালু হতেই ধারা ঘুরে গেল; ট্রাক–বাস অন্য পথে চলে গেল, ভিড় কমল, কেনাবেচা পড়ে গেল। একটি রাস্তা পুরো এলাকার অর্থনীতি ও সামাজিক প্রাণশক্তি কিভাবে পাল্টে দেয়—সেটি আমি চোখে দেখেছি। শিক্ষা স্পষ্ট—সংযোগ প্রান্তকে কেন্দ্র বানায়, আবার কেন্দ্রকে প্রান্তেও ঠেলে দিতে পারে।

ভাঙ্গার রূপান্তর : প্রান্ত থেকে কেন্দ্র
ফরিদপুরের ভাঙ্গা দীর্ঘদিন প্রান্তিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্ষায় জমি ডুবে থাকত, কৃষিই ছিল প্রধান জীবিকা। পদ্মা সেতু রাতারাতি এই প্রান্তকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। আজ সেখানে শিল্প ও লজিস্টিকস গড়ে উঠছে, জমি ইজারা দিয়ে কৃষকরা নতুন আয় পাচ্ছেন, বিনিয়োগকারীরা গুদাম ও কারখানা স্থাপন করছেন, স্থানীয় তরুণরা রাজধানী না গিয়েই চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন। সংযোগ প্রান্তকে জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে রূপান্তর করেছে।

সংযোগ নিয়ন্ত্রণ মানেই শক্তি : বৈশ্বিক শিক্ষা
বিশ্ব-রাজনীতির ইতিহাস বলে—যে সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই শক্তির কেন্দ্রে। ক্ষুদ্র ভূখণ্ড হলেও সিঙ্গাপুর বছরে চার কোটিরও বেশি কনটেইনার সামলিয়ে আজ বৈশ্বিক ট্রান্সশিপমেন্টের কেন্দ্র। হরমুজ প্রণালীতে সামান্য বিঘ্ন মানেই বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজারে ধাক্কা। মালাক্কা প্রণালীতে বছরে নব্বই হাজারের বেশি জাহাজ চলাচল করে; এটি পূর্ব এশিয়ার প্রধান সংকটবিন্দু। আর ২০২১ সালে সুয়েজ খাল এক সপ্তাহ বন্ধ থাকায় পুরো বিশ্ব সরবরাহশৃঙ্খল কেঁপে উঠেছিল। বাংলাদেশের জন্য সেই কৌশলগত বিন্দু হলো বঙ্গোপসাগর।

জেলে-পল্লী থেকে বৈশ্বিক শক্তি
সিঙ্গাপুর একদিন ছিল মৎস্যজীবীদের ছোট্ট জনপদ। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও তারা বুঝেছিল—অবস্থানই আসল শক্তি। আধুনিক বন্দর, নির্ভুল সরবরাহব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক ট্রানজিট কেন্দ্র গড়ে তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির শীর্ষে উঠেছে। বাংলাদেশের শিক্ষা স্পষ্ট—সমুদ্রকে কেবল মৎস্য আহরণের ক্ষেত্র হিসেবে দেখলে সীমিত লাভ হবে; কৌশলগতভাবে কাজে লাগালে সমুদ্রই হবে অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির আসল শক্তির উৎস।

সমুদ্রপথে সমৃদ্ধি : সম্ভাবনার নীল নকশা
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগ সমুদ্রপথে হয়। মৎস্যখাত কোটি মানুষের জীবিকার ভরসা এবং প্রোটিনের প্রধান উৎস। তবে সম্ভাবনা এর বাইরেও বিস্তৃত—সামুদ্রিক পর্যটন, জাহাজ নির্মাণ-মেরামত, সমুদ্রজীবপ্রযুক্তি, উপকূলভিত্তিক পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ইতিমধ্যেই নতুন দিগন্ত খুলছে। তেল–গ্যাস অনুসন্ধান এবং চট্টগ্রামের বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সরবরাহকেন্দ্র বানাতে পারে।

সম্ভাবনার পাশাপাশি সংকট
অবৈধ মাছ ধরা (অবৈধ, অঘোষিত ও নিয়ন্ত্রনবিহীন আহরণ) রাজস্ব ক্ষতি করছে ও মজুদ কমাচ্ছে। জলদস্যুতা, পাচার ও সীমান্ত অপরাধ নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি হতে পারে, যা মানবিক সংকটের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার বড় ইস্যু।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার নীতি-স্তম্ভ
প্রথমত, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও কূটনীতি: নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড আধুনিকীকরণ, স্যাটেলাইট নজরদারি ও ড্রোন টহল, আঞ্চলিক সংস্থা বিমস্টেক ও আইওরা’র প্ল্যাটফর্মে সহযোগিতা, এবং বঙ্গোপসাগরকে কূটনৈতিকভাবে ইন্দো–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি সংকটবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয়ত, বন্দর উন্নয়ন ও সংযোগ: চট্টগ্রাম ও মোংলা আধুনিকীকরণ, বে টার্মিনাল বাস্তবায়ন, মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর চালু, ডিজিটাল কাস্টমস, কনটেইনার ট্র্যাকিং ও স্মার্ট লজিস্টিকস। তৃতীয়ত, নীল অর্থনীতি: টেকসই মাছ আহরণ, জাহাজ নির্মাণ ও সামুদ্রিক পর্যটনকে অগ্রাধিকার, অফশোর বায়ুশক্তি, সমুদ্রজীবপ্রযুক্তি ও খনিজ আহরণে বিনিয়োগ আকর্ষণ, নির্ধারিত ব্লকে তেল–গ্যাস অনুসন্ধান। চতুর্থত, জলবায়ু কূটনীতি ও মানবিক নিরাপত্তা: ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল নিশ্চিত করা, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও সহনশীল অবকাঠামো তৈরি, জলবায়ুকে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে অন্তর্ভুক্তকরণ।

প্রতিবেশী দেশগুলোর বন্দরহীনতা ও বাংলাদেশের সুযোগ
নেপাল, ভুটান, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোন রাজ্য, এমনকি তিব্বতের মতো অঞ্চল সমুদ্রপথ থেকে বঞ্চিত। তাদের আমদানি-রপ্তানির একমাত্র কার্যকর প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের বন্দর। এর ফলে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই আঞ্চলিক কেন্দ্রবিন্দু। এই অবস্থান থেকে ট্রানজিট আয়, কর্মসংস্থান, বিদেশি বিনিয়োগ ও আঞ্চলিক শিল্পাঞ্চল তৈরি হবে—যা বাংলাদেশের ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বাড়াবে।

তাৎক্ষণিক ও কৌশলগত প্রভাব
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব তাৎক্ষণিক হবে—বন্দর আয় দ্রুত বাড়বে, লক্ষাধিক কর্মসংস্থান তৈরি হবে, আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রবাহ অর্থনীতিকে নতুন গতি দেবে। শিল্পাঞ্চল ও লজিস্টিকস কেন্দ্র গড়ে ওঠার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি সরাসরি বৈশ্বিক প্রবাহে যুক্ত হবে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি
অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গুরুত্বও বাড়বে। বঙ্গোপসাগরকে কৌশলগত সংকটবিন্দু হিসেবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, বরং ইন্দো–প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা কাঠামোর অপরিহার্য অংশীদার হবে। জলবায়ু কূটনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খলে কেন্দ্রীয় ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থানকে বহুগুণে শক্তিশালী করবে।

সংযোগ থেকে শক্তি, শক্তি থেকে ভবিষ্যৎ বঙ্গোপসাগরই বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন ইঞ্জিন, কূটনীতির নতুন পুঁজি এবং নিরাপত্তার নতুন ছায়াতল। আজকের সঠিক সিদ্ধান্ত শুধু দীর্ঘমেয়াদি নয়, বরং তাৎক্ষণিকভাবেই দেশের ভাগ্য বদলাতে সক্ষম। সংযোগই শক্তি—আর সেই শক্তিই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, প্রান্ত থেকে আঞ্চলিক, আর আঞ্চলিক থেকে বৈশ্বিক শক্তিতে উত্তরণের পথে।

লেখক : উদ্যোক্তা, কলামিস্ট ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক

পাঠকের মতামত:

০১ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test