E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিশ্ব বসতি দিবস: নগর সমস্যা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রেক্ষাপট

২০২৫ অক্টোবর ০৬ ১৭:৩৭:৪১
বিশ্ব বসতি দিবস: নগর সমস্যা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রেক্ষাপট

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার বিশ্ববাসী বিশ্ব বসতি দিবস (World Habitat Day) উদযাপন করে। দিবসটি ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত হয়, মূলত মানুষ এবং বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। এই দিবসটি মূলত নগরায়ন, বসতি, পরিবেশ এবং মানব বসতির মান উন্নয়নের উপর আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ আনার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। ২০২৫ সালে বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপন করা হচ্ছে ‘Urban Crisis Response’ প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে। বাংলায় এর সরল অর্থ দাঁড়ায় ‘পরিকল্পিত উন্নয়নের ধারা, নগর সমস্যায় সাড়া’, যা বর্তমান বৈশ্বিক নগর সমস্যা ও সমাধানের প্রয়াসকে চিত্রিত করে।

নগরায়ন ক্রমশ বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে নগরায়ন মানে শুধু শহর সম্প্রসারণ নয়, এটি একটি জটিল চ্যালেঞ্জ যা সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক মাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলছে। শহরের উন্নয়ন যখন দ্রুত হচ্ছে, তখন নাগরিকদের জীবনযাত্রা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা সকল ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বসতি দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নগরায়ন এবং মানব বসতি উন্নয়ন কেবল পরিমাপযোগ্য অবকাঠামোর বিষয় নয়, বরং এটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পিত নীতির সঙ্গে সমন্বিত হওয়া উচিত।

নগরায়নের বাস্তব চিত্র

বর্তমান বৈশ্বিক নগরায়ন একটি দ্বৈত প্রভাবের উদাহরণ। একদিকে, শহরগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উদ্ভাবন ও শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করছে। শহরে বসবাসের সুবিধা যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগে মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে, তেমনি নগরায়ন অনেক চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে।

১. আবাসন সংকট ও উচ্ছেদ সমস্যা: দ্রুত নগরায়নের ফলে বড় শহরগুলোতে সুলভ, নিরাপদ ও যোগ্য মানের আবাসনের অভাব দেখা দিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত বসতি, স্লাম এলাকা ও উচ্চ ভাড়া নগর মানুষের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

২. পরিবেশ ও দূষণ: নগরায়ন বনাঞ্চল ও সবুজ স্থান কমাচ্ছে। এর সঙ্গে গাড়ি, শিল্প ও আবাসনের কারণে বায়ু ও শব্দ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাধার ও খনিজ সম্পদের উপর চাপ বেড়ে চলেছে, যা নগর পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে।

৩. পরিবহন ও ট্রাফিক সমস্যা : শহরের অবকাঠামো যত দ্রুত বাড়ছে, তত দ্রুত মানুষ ও যানবাহনের চাপ বেড়ে চলেছে। যানজট, দূষণ, ও সড়ক দুর্ঘটনার হার নগর জীবনের এক চরম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: নগরায়নের কারণে ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান আরও গভীর হচ্ছে। আধুনিক শহরগুলোতে সুবিধাভোগী ও সুবিধাহীন মানুষের মধ্যে সুযোগের বৈষম্য স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

৫. প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নগর ঝুঁকি: ভ্যুরবারি ও উষ্ণায়ন, বন্যা, হারিকেন, সাইক্লোন ইত্যাদির ফলে শহরের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন এবং দুর্বল পরিকল্পনার কারণে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো নাগরিকদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

জাতিসংঘের এবারের প্রতিপাদ্য ‘Urban Crisis Response’ নগর সমস্যার সমাধানকে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরেছে। অর্থাৎ, শুধু নগরায়ন ঘটানো নয়, বরং সেই নগরায়নকে পরিকল্পিত ও স্থায়ী উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বয় করা অত্যন্ত জরুরি।

পরিকল্পিত নগরায়ন মানে হলো নগর কাঠামো তৈরি করা যেখানে জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সবকিছু একসাথে সমন্বিত থাকে। এর মূল ভিত্তি হলো –

১. দক্ষ পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন: নগরায়নের প্রাথমিক পর্যায়েই সঠিক নীতি গ্রহণ এবং পরিকল্পনা না হলে পরে পুনর্বিন্যাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। সড়ক, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ, আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা – প্রতিটি ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. প্রযুক্তির ব্যবহার: আধুনিক শহরগুলোতে স্মার্ট সিটি প্রযুক্তি যেমন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, দূষণ নিরীক্ষণ, শক্তি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে নগর প্রশাসনকে সহায়তা করতে পারে। প্রযুক্তি নগর সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. সমাজভিত্তিক সমাধান: নগর সমস্যার সমাধান কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং নাগরিকদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। নগর মানুষের মতামত, চাহিদা ও সমস্যা বোঝার মাধ্যমে কার্যকর সমাধান সম্ভব।

৪. দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা: পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা, সবুজ স্থান বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ হ্রাস, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহার এবং জলাশয় সংরক্ষণ নগর জীবনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে।

৫. সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়: নগরের সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ জীবন, সুষম সুযোগ এবং সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে শহর জীবনের মান উন্নত হয়।

বিশ্ববাসী ও নগরায়ন: বাস্তব চ্যালেঞ্জ

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নগরায়ন হচ্ছে দ্রুত, অনিয়ন্ত্রিত ও অনিয়মিত। ২০২৫ সালের নাগরিক সংখ্যা অনুযায়ী, পৃথিবীর ৬৮% মানুষ শহরে বসবাস করবে। এটি একদিকে নগরায়নের সুবিধা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে বহু চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে।

* চ্যালেঞ্জের কিছু উদাহরণ:-আবাসনের অভাব: বহু শহরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য সুলভ আবাসন নেই। স্লাম এলাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

* পরিবেশ বিপর্যয়:- নদী, জলাধার, বনাঞ্চল ও খোলা জমি দখল হচ্ছে। ফলে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

* পরিবহন সমস্যা:- যানজট, যানবাহন দূষণ ও যাত্রী নিরাপত্তা নাগরিক জীবনের বড় সমস্যা।

* স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা:- শহরে জনঘনত্ব বেশি, ফলে সংক্রমণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অপরাধের হার বাড়ছে।

এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ‘Urban Crisis Response’ নীতি অনুসারে, যা নগরের প্রাকৃতিক, সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করে।

উদাহরণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বের অনেক শহর ইতোমধ্যেই স্মার্ট সিটি এবং টেকসই নগরায়ন নীতি গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ:

১. কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক: শহরটি পরিবেশ বান্ধব এবং বাসযোগ্য শহর হিসেবে পরিচিত। সাইক্লিং নীতি, সবুজ প্রযুক্তি ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এটি নগরায়ন সমস্যা সমাধানে উদাহরণ স্থাপন করেছে।

২. সিঙ্গাপুর: আবাসন, জলবায়ু, ট্রাফিক এবং বন্যা প্রতিরোধে সিঙ্গাপুরের পরিকল্পিত নগরায়ন নীতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

৩. মুম্বাই, ভারত: যদিও বড় শহর, মুম্বাই কিছু পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যেমন স্লাম পুনর্বাসন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট উন্নয়ন।এ ধরনের উদাহরণ প্রমাণ করে যে, নগরায়নের সমস্যা সমাধানে পরিকল্পিত উদ্যোগ, প্রযুক্তি ব্যবহার ও নাগরিক অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশও দ্রুত নগরায়নের পথে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী সহ শহরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ট্রাফিক জ্যাম, দূষণ, স্লাম এলাকা ও জলাবদ্ধতা সমস্যার সাথে লড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের সিটি করপোরেশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পরিকল্পনা ও স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ নগর সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করছে। তবে, নাগরিক সচেতনতা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব সমস্যার গভীরতা বাড়াচ্ছে।বাংলাদেশে Urban Crisis Response নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে নগর জীবনযাত্রার মান, নিরাপত্তা ও পরিবেশের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে। সঠিক নগর পরিকল্পনা, স্লাম পুনর্বাসন, পরিবেশ বান্ধব অবকাঠামো এবং নাগরিক অংশগ্রহণ নগরায়নকে টেকসই করবে।

বিশ্লেষণ: নাগরিক দায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি

‘Urban Crisis Response’ শুধু প্রশাসনের নয়, নাগরিকেরও দায়িত্বের কথা স্মরণ করায়। নাগরিকরা কেবল সুবিধাভোগী নয়, নগরায়নের অংশীদার। সঠিক বাসস্থান, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন, দূষণ কমানো, যানবাহন ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সহমর্মিতা নগর সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ।

ভবিষ্যৎ নগরায়ন পরিকল্পনার জন্য মূল দিকগুলো

* স্মার্ট ও টেকসই নগর পরিকল্পনা: প্রযুক্তি ও নীতিনির্ধারণের সমন্বয়।

* সামাজিক অংশগ্রহণ: নাগরিকদের মতামত ও সমস্যা সমাধানে সম্পৃক্ত করা।

* পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ: সবুজ স্থান বৃদ্ধি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহার।

* আবাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা: স্লাম পুনর্বাসন, নিরাপদ ও সুলভ আবাসন নিশ্চিত করা।

* প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা: নগর ঝুঁকি হ্রাসে অবকাঠামো ও জরুরি ব্যবস্থা। এভাবে নগরায়ন কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং মানবিক ও পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই ও মানুষের জন্য উপযোগী করা সম্ভব।

পরিশেষে বলতে চাই,২০২৫ সালের বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘Urban Crisis Response’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, নগরায়ন হচ্ছে মানব বসতির একটি মৌলিক অংশ, কিন্তু এটি যদি পরিকল্পিত না হয়, তবে তা শুধু সুবিধা নয়, সমস্যা ও সংকটও তৈরি করে। নগরায়ন সমস্যা সমাধানে সরকার, প্রশাসন, প্রযুক্তি, নাগরিক অংশগ্রহণ ও পরিবেশ বান্ধব নীতি একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে।

নগর জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান শুধুমাত্র অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়, বরং মানুষের জীবনমান, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ ও ন্যায়ের সঙ্গে সংযুক্ত। পরিকল্পিত নগরায়ন এবং নগর সমস্যার প্রতি সময়োপযোগী সাড়া দেওয়া আমাদের সমাজকে আরও টেকসই, মানবিক ও সমৃদ্ধিশালী করতে পারে।

বিশ্ববাসীকে এই দিবস স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শহর হচ্ছে শুধু বাড়ি বা ভবনের সমষ্টি নয়, এটি হলো মানুষের জীবন, সামাজিক বন্ধন ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। তাই ২০২৫ সালে ‘Urban Crisis Response’ প্রতিপাদ্য আমাদের নগরায়নের ভবিষ্যৎকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে প্রেরণা দিচ্ছে। এটি শুধু একটি দিবস উদযাপন নয়, বরং একটি সংকেত যে, আমরা কীভাবে আমাদের শহরগুলোকে মানুষের জন্য আরও বসবাসযোগ্য, নিরাপদ ও টেকসই করতে পারি।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৬ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test