E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ধর্মের ছদ্মবেশে জাতি ধ্বংসের উৎসব

২০২৫ অক্টোবর ০৬ ১৮:১০:০৪
ধর্মের ছদ্মবেশে জাতি ধ্বংসের উৎসব

আবীর আহাদ


ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য মানবতা, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা। অথচ আজ ধর্মের নামেই চলছে বিভাজন, সহিংসতা ও নৈতিক অবক্ষয়। ধর্মকে পুঁজি করে স্বার্থের রাজনীতি, লোভের বাণিজ্য ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা জাতির অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ যেন এক মহোৎসব: ধর্মের ছদ্মবেশে জাতিধ্বংসের উৎসব।

১. মুখোশের আড়ালে ধর্ম

বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে ধর্ম একসময় ছিল আত্মিক মুক্তি ও নৈতিকতার দিশারি। কিন্তু আজ ধর্মের নামেই চলছে আত্মস্বার্থের প্রতিযোগিতা। যাদের ন্যায়ের কথা বলার কথা, তারাই ধর্মের বুলি তুলে অন্যকে দমন করছে। ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে; এখন এটি ক্ষমতার মুখোশ মাত্র। ধর্মের শুদ্ধতার পরিবর্তে চলছে ধর্মের অভিনয়, যার ভেতরে লুকানো আছে লোভ, বিকৃতি, প্রতারণা ও বিভাজনের বিষ।

২. ধর্ম থেকে ধর্মের অভিনয়ে

একটি জাতিকে ধ্বংস করতে যুদ্ধের প্রয়োজন হয় না; প্রয়োজন হয় নৈতিকতার অবক্ষয়। আজ দেখা যায়, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তি ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে আত্মরক্ষা করে, বিভাজন সৃষ্টিকারীরা ধর্মীয় স্লোগান তোলে, আর অসত্যের প্রচারকরা নিজেদের “ধর্মরক্ষক” ঘোষণা করে। ফলস্বরূপ, ধর্মের প্রকৃত চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে; জাতির বিবেক ঘুমিয়ে পড়ছে মিথ্যা ধার্মিকতার ধোঁয়ায়। এই অবস্থায় ধর্ম হয়ে উঠছে মানুষের মুক্তির নয়, বরং দাসত্বের হাতিয়ার।

৩. সংবিধান ও ধর্মের ব্যবহার

বাংলাদেশের সংবিধান ঘোষণা করে: “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ, এবং প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত।” অর্থাৎ, ধর্ম কোনো গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়; এটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। কিন্তু আজ দেখা যায়, ধর্মের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করছে। এভাবে সংবিধানের অন্তর্নিহিত “ধর্মনিরপেক্ষ ন্যায়বিচারের চেতনা” ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। ধর্ম তখন আর নৈতিকতার নয়, বরং রাজনীতির মুদ্রা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানে যে চার মূলনীতি: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা ছিল একটি মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারা ধর্মের নামে সেই মূলনীতিকে কলুষিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করে তারা বিভ্রান্তির বীজ বপন করে, যা আজও জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করছে।

৪. ধর্মবিকৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের সংকট

ধর্মের নামে বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘নাস্তিক’ ও ‘ভারতের দালাল’ বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয়েছিল ‘ভারতীয় চক্রান্ত’। এভাবেই ধর্মকে ব্যবহার করে জাতির আত্মপরিচয়কে বিকৃত করা হয়েছিল।
যে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত, মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা, সেই যুদ্ধের চেতনাকেই ধ্বংস করার অপচেষ্টা আজো চলে ধর্মের ছদ্মবেশে। ধর্ম তখন ন্যায়বিচারের নয়, বরং প্রতারণার পর্দা হয়ে ওঠে, যার আড়ালে জাতির ইতিহাস ও চেতনাকে হত্যা করা হয়।

৫. সামাজিক ক্ষয় ও মানসিক বিভাজন

ধর্মের ছদ্মবেশে চলা এই ভণ্ডামি সমাজে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত সৃষ্টি করছে। মানুষের মধ্যে আস্থা ভাঙছে, শ্রদ্ধা হারাচ্ছে, সহনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। ধর্ম এখন অনেকের কাছে ভালোবাসার নয়, ভয়ের প্রতীক। ফলত সমাজে বাড়ছে হিংসা, কূপমণ্ডূকতা ও ঘৃণার রাজনীতি। যে ধর্ম একসময় মানবতার উৎস ছিল, আজ সেই ধর্মই মানুষের মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছে।

৬. ধর্ম ও মানবতার পুনর্মিলন

তবুও সব শেষ হয়ে যায়নি। ধর্মের প্রকৃত শক্তি নিহিত আছে ভালোবাসা, দয়া ও সত্যের মধ্যে।
ধর্ম তখনই মহৎ, যখন তা মানুষকে বিভক্ত নয়, একীভূত করে। প্রকৃত ধর্মীয় মানুষ সে-ই, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, আর অন্যের কষ্টে নিজের হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করে। এই ধর্মই পারে জাতিকে উদ্ধার করতে- ভণ্ডামি, ভয়, বিকৃতি ও বিভাজনের ছায়া থেকে।

৭. শেষকথা

ধর্মের ছদ্মবেশে জাতিধ্বংসের এই উৎসব শেষ করতে হলে প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্ব, সচেতন নাগরিক সমাজ, ও শিক্ষিত মানবিক মূল্যবোধ। যেদিন মানুষ ধর্মকে নয়, মানবতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে,
সেদিনই ভণ্ড ধার্মিকতার উৎসব শেষ হবে। ধর্ম তখন আবার ফিরে আসবে তার আসল রূপে—ন্যায়, সত্য ও মানবতার সোনালী পতাকা নিয়ে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও বিশ্লেষক।

পাঠকের মতামত:

০৬ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test