E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বাংলাদেশে ইন্টারনেট: বর্তমান ব্যবহার, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি

২০২৫ অক্টোবর ২৮ ১৭:২৬:৪১
বাংলাদেশে ইন্টারনেট: বর্তমান ব্যবহার, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি

ওয়াজেদুর রহমান কনক


আজকের বিশ্ব অনলাইনে—প্রায় ৫.৫–৫.৬ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে; অর্থাৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এখন অনলাইনে সংযুক্ত। 

স্মার্টফোন ছাড়া আজকের এই বিস্তার কখনোই সম্ভব হতো না—মোবাইল প্রযুক্তি ও স্মার্টফোনের দ্রুত গ্রহণই ইন্টারনেট অ্যাক্সেসকে প্রত্যেক মানুষের পকেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন ও সংযুক্ত ডিভাইসের বিপুলসংখ্যা ডিজিটাল সংযোগকে জীবনের অনুষঙ্গ করে তুলেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বিশ্বজুড়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ; কয়েক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় এবং গড় আকারে প্রতিদিনই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দুই ঘণ্টার ওপরে সময় কাটাচ্ছেন—ফরাসিতে কথায়, স্ক্রিন ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোই আজকার জনজীবনের মানচিত্র আঁকছে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লব আরও দ্রুত। জাতীয় নিয়ন্ত্রক ও গণমাধ্যম সূত্রে ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩০–১৩৫ মিলিয়ন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাদের বড় অংশই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী; দেশের ইন্টারনেট প্রবেশহার প্রায় ৭৫–৭৮% এবং ডিজিটাল অর্থনীতি এখন দেশের মোট তৈরি অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

অর্থনীতির দৃষ্টিকোণে ডিজিটাল সংযোগের গুরুত্ব অপরিসীম—একাধিক বৈশ্বিক গবেষণা দেখায় যে ব্রডব্যান্ড ও ডিজিটাল সার্ভিসের প্রসার একটি দেশের উৎপাদনশীলতা ও GDP-তে পরিমিতভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে; সময়ের সঙ্গে অনলাইন সংযুক্তি বেড়ে গেলে কর্মসংস্থান, ই-কমার্স ও ডিজিটাল পরিষেবার মাধ্যমে অর্থনৈতিক আয়ও বৃদ্ধি পায়।

এই ভরাট পরিসংখ্যানগুলোই ইন্টারনেট দিবসকে শুধুমাত্র স্মরণীয় লক্ষ্য করে না—এরা আমাদের স্মরণ করায়, ১৯৬৯-এর ঐ অনানুষ্ঠানিক “LO” বার্তাটি থেকে আজকের বিশ্বজোড়া সংযোগ পর্যন্ত কতদূর বিস্তৃত হওয়া সম্ভব হয়েছে; এবং একই সঙ্গে তুলে ধরে নতুন ধারণা, সুযোগ ও দায়িত্ব—নিরাপত্তা, অন্তর্ভুক্তি ও তথ্যবিশ্বাসযোগ্যতা—যেগুলো আমাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
প্রযুক্তি ও তথ্যবিজ্ঞানের ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আছে, যেগুলো মানবসভ্যতার গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। সেইসব যুগান্তকারী মুহূর্তের একটি হলো ২৯ অক্টোবর—বিশ্ব ইন্টারনেট দিবস (International Internet Day)। প্রতি বছর এ দিনটি উদযাপন করা হয় ডিজিটাল যুগের সূচনার প্রতীক হিসেবে। কারণ ১৯৬৯ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো দুটি কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে—যে ঘটনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় আধুনিক ইন্টারনেটের যাত্রা।

১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিওনার্ড ক্লেইনরক (Leonard Kleinrock) ও তাঁর গবেষণা দল এক ঐতিহাসিক পরীক্ষা চালান। সেই রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (UCLA) এবং স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (Stanford Research Institute)-এর মধ্যে প্রথম কম্পিউটার সংযোগ স্থাপিত হয়। প্রকল্পটির নাম ছিল ARPANET (Advanced Research Projects Agency Network), যা মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছিল।

প্রথম পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছিল একটি সহজ শব্দ—“LOGIN”। কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে গন্তব্যে পৌঁছায় কেবল “LO”। সেই অসম্পূর্ণ বার্তাটিই মানব ইতিহাসে প্রযুক্তিগত যোগাযোগের প্রথম সোপান হিসেবে অমর হয়ে আছে। বলা যায়, এই “LO” শব্দজোড়াই আধুনিক ইন্টারনেট যুগের জন্মবার্তা।

ARPANET শুরু হয়েছিল মাত্র চারটি কম্পিউটার নোড নিয়ে। কিন্তু সেই ছোট নেটওয়ার্ক দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ১৯৭৩ সালে উদ্ভাবিত TCP/IP প্রোটোকল ইন্টারনেটের ভিত্তি মজবুত করে। ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রোটোকল ব্যবহার শুরু হলে ইন্টারনেটের কাঠামো স্থিতিশীল হয়।

১৯৯১ সালে টিম বার্নার্স-লি (Tim Berners-Lee) “World Wide Web” আবিষ্কার করলে ইন্টারনেট গণমানুষের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। তখন থেকে তথ্য, জ্ঞান ও যোগাযোগ হয়ে ওঠে আঙুলের ছোঁয়ায় পাওয়া এক নতুন বাস্তবতা।

ইন্টারনেট দিবস প্রথম পালিত হয় ২০০৫ সালে। উদ্যোগ নেয় স্পেনের টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান Telefónica ও Asociación de Usuarios de Internet (AUI)। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগে যে বিপ্লব ঘটেছে, তা উদযাপন করা। পরবর্তীতে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা এ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।

২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮.১ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৫.৪ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে—অর্থাৎ বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ এখন সংযুক্ত অনলাইন জগতে।

২০০০ সালে যেখানে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০ মিলিয়ন, সেখানে আজ তা বেড়ে ১৩ গুণেরও বেশি হয়েছে। বর্তমানে এশিয়া এককভাবে বিশ্বের ৫৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ধারণ করছে, যেখানে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া শীর্ষে। আফ্রিকায় প্রবেশ হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, বৃদ্ধি হার সবচেয়ে দ্রুত—প্রতি বছর প্রায় ১৩ শতাংশ হারে নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছে।

বিশ্বে এখন প্রায় ৬.৮ বিলিয়ন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে, যা ইন্টারনেট বিস্তারের মূল চালিকা শক্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রায় ৪.৯ বিলিয়ন, এবং গড়ে প্রতিজন ব্যবহারকারী প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ৩৫ মিনিট সময় ব্যয় করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে।

বাংলাদেশ ইন্টারনেট বিপ্লবে দ্রুত অগ্রসর দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর ২০২৫ সালের শুরুর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১২ কোটি ৬০ লাখ, আর ব্রডব্যান্ড (ISP) ব্যবহারকারী প্রায় ৯০ লাখের বেশি।

ইন্টারনেট প্রবেশ হার বর্তমানে প্রায় ৭৮ শতাংশ। দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৫.৫ শতাংশ এখন ডিজিটাল অর্থনীতির মাধ্যমে আসে। দেশে সক্রিয় ওয়েবসাইটের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি, এবং প্রতিদিন প্রায় ৬ কোটি মানুষ ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছে।

ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং—এই তিন খাত মিলিয়ে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক আয় করছে।

আজ ইন্টারনেট কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আধুনিক সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, কৃষি, সাংবাদিকতা—সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট এখন অপরিহার্য। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, কোনো দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ১০ শতাংশ বাড়লে সেই দেশের জিডিপি গড়ে ১.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় ইন্টারনেটই বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল। শিক্ষা ও কর্মজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল ডিজিটাল সংযোগ।

তবে ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার সঙ্গে এসেছে নানা চ্যালেঞ্জও। ডিজিটাল বিভাজন, সাইবার অপরাধ, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা ও ভুয়া তথ্যের প্রসার এখন বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয়। জাতিসংঘের “Digital Cooperation Roadmap” অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রত্যেক নাগরিকের কাছে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

ইন্টারনেট দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—মানব ইতিহাসে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রা কেবল যন্ত্রের নয়, এটি মানবমনের সৃজনশীলতার প্রতিফলন। ১৯৬৯ সালের সেই সংক্ষিপ্ত “LO” বার্তা আজ রূপ নিয়েছে এক বিশাল বৈশ্বিক সংযোগে—যেখানে জ্ঞান, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ মিলেমিশে গড়ে তুলছে এক নতুন সভ্যতার ভিত্তি।

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ — প্রায় ৫.৬ বিলিয়ন — ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, যা ২০২৫ সালের গোড়ার তথ্য অনুযায়ী নিশ্চিত। ([DataReportal – Global Digital Insights][1])
অন্য দিকে, ২.৫–২.৬ বিলিয়ন মানুষ এখনও অনলাইন‑সংযুক্ত নয়, অর্থাৎ আজও “অফলাইন” জীবনে রয়েছেন।

এই তথ্য দেখায় প্রযুক্তির বিস্তার যে কত দ্রুত ঘটছে, আর সঙ্গে স্মরণ করায় ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির কাজ এখনও অসম্পূর্ণ।

এই প্রেক্ষাপটে, ইন্টারনেট দিবস শুধু উদযাপনের দিন নয়; এটি অনুপ্রেরণা ও পর্যালোচনার আহ্বানও বয়ে আনে। আমরা যেখানে আছি, সেখানে থেমে থাকা যায় না। প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক যোগাযোগে ইন্টারনেটের অবদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার অন্তর্ভুক্তি ও সমতা নিশ্চিত করা আমাদের বড় দায়িত্ব।

ডিজিটাল যুগে প্রবেশের পথে এখনও রয়েছে—

গ্রামীণ ও অপরিবর্তিত অঞ্চলে অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা

শিক্ষার সুযোগ ও ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি

নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারের অভাব

এই চ্যালেঞ্জগুলোই আগামী দিনের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি-এর বড় প্রেক্ষাপট নির্ধারণ করবে। যেখানে ইন্টারনেট প্রবেশহার দ্রুত বাড়ছে (যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে), সেখানে দ্বিতীয় ধাপের কাজ—শুধু সংযোগ নয়, সংযোগের মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান, সুযোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস—শুরু করা জরুরি।

ইন্টারনেট দিবস আমাদের স্মরণ করায়, ইন্টারনেট কেবল প্রযুক্তিগত অর্জন নয়, এটি সামাজিক ব্যবস্থার অংশ, মানব জীবনের অপরিহার্য কাঠামো। এবং যত দ্রুতই আমরা সংযুক্ত হই, ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে—“কতটা অংশীদারিত্বমূলক, কতটা সবার জন্য খোলা”।

পরিশেষে, আজকের ইন্টারনেট দিবস আমাদের দেয় একটি শুভ স্মারক, কিন্তু সঙ্গে থাকে এক প্রতিশ্রুতি—“ব্যবহার হোক সংযোগ, সংযোগ হোক অন্তর্ভুক্তি, অন্তর্ভুক্তি হোক সবার সুযোগ”। পথ এখনও বিস্তৃত; আজকের সংযোগই আগামী দিনের নেতা, উদ্যোক্তা ও গবেষকের পথপ্রদর্শক।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৮ অক্টোবর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test