E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মানবতার রঙে রক্ত ও চোখের জীবন

২০২৫ নভেম্বর ০১ ১৭:৪৭:০৬
মানবতার রঙে রক্ত ও চোখের জীবন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


২ নভেম্বর, আমরা উদযাপন করছি জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস ২০২৫। এটি কেবল একটি দিন নয়, বরং মানবতার উৎসব—যেখানে “দান” মানে কেবল বস্তু নয়, বরং জীবন ও আলো দান। একদিকে রক্তের ফোঁটায় কারো জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে মৃত্যুর পর নিজের চোখ দিয়ে কারো পৃথিবী দেখার স্বপ্ন—দুটিই মানবতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

রক্ত এমন এক অমূল্য সম্পদ, যা কোনো যন্ত্র বা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা যায় না। মানুষই মানুষকে রক্ত দিতে পারে। আমাদের দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়, কিন্তু নিয়মিত সংগৃহীত রক্তের পরিমাণ সেই তুলনায় অনেক কম। দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, সন্তান প্রসব বা ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ রক্তের জন্য অপেক্ষা করে। প্রতিটি রক্তের ফোঁটা মানে কোনো পরিবারের আশার আলো, কোনো জীবনের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি।

একজন সুস্থ মানুষ মাত্র কিছু মিলিলিটার রক্ত কয়েক মাস পরপর দিতে পারেন। এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না; বরং শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, এবং মানসিক স্বাস্থ্যও শক্তিশালী হয়। নিয়মিত রক্তদানের ফলে শরীরের আয়রনের ভারসাম্য বজায় থাকে, রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা কমে যায়, এবং একজন মানুষ নিজের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব অনুভব করে।

স্বেচ্ছায় রক্তদান মানে কেবল চিকিৎসা সহায়ক কাজ নয়; এটি একজন মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার মহৎ দান। রক্তদাতা হয়তো জানেন না—তার রক্তের ফোঁটায় কোনো মা সন্তানকে কোলে পেয়েছেন, কোনো বৃদ্ধ আবার জীবনের আলো দেখছেন, কিংবা কোনো শিশু হাসছে। এই আনন্দের মাপ হয় না; এটি কেবল অনুভব করা যায়। প্রতিটি রক্তদান একজন মানুষের জীবনের গল্প বদলে দেয়।

ইসলাম জীবন রক্ষাকারী প্রতিটি কাজকে ইবাদত হিসেবে দেখেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—“যে একজন মানুষকে বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাল।” এই আয়াত প্রমাণ করে যে রক্তদান কেবল মানবিক কাজ নয়; এটি আধ্যাত্মিক দান, ইবাদতের অংশ। জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় দান আর কিছু হতে পারে না। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্টান—কোনো ধর্মই জীবন বাঁচানোর দানকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং সব ধর্ম মানুষকে অন্যের কল্যাণে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছে।

রক্তদানের পাশাপাশি মানবতার আরেক মহান প্রতীক হলো মরণোত্তর চক্ষুদান। চোখ—যার মাধ্যমে আমরা দেখি পৃথিবীর রঙ, প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রিয়জনের মুখ। বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ মানুষ দৃষ্টিহীন, যাদের অনেকেই কর্নিয়া নষ্ট হওয়ার কারণে দেখতে পান না। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করলে তাদের অনেকের দৃষ্টি ফিরে আসতে পারে—শুধু একজন চক্ষুদাতার কারণে।

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দাতার কর্নিয়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা যায় এবং অন্যের চোখে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। এক জোড়া চোখ মানে দুইজন অন্ধ মানুষের পৃথিবী দেখা সম্ভব। মৃত্যুর পরও কারো জীবনে আলো ফিরিয়ে দেওয়া—এটি এক অনন্য মানবিক উত্তরাধিকার। কারো জীবন যেমন রক্তের মাধ্যমে বাঁচানো যায়, তেমনি কারো চোখের দান এক অন্ধ মানুষকে নতুন জীবন দেখার সুযোগ দেয়।

বাংলাদেশে চক্ষুদান আন্দোলনের সূচনা করেন অধ্যাপক ডা. মোহিতুল ইসলাম। তিনি ১৯৭৫ সালে “চক্ষুদান সমাজ” প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে “আই ব্যাংক অব বাংলাদেশ” চালু করেন। তাঁর উদ্যোগেই দেশে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের যুগ শুরু হয়। অসংখ্য অন্ধ মানুষ তার কারণে আবার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন। তবে দাতার সংখ্যা এখনও সীমিত। সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা—যেমন “চোখ দান করলে মৃতদেহ অসম্পূর্ণ থাকবে” বা “ধর্মে নিষিদ্ধ”—মানুষকে পিছিয়ে রাখছে। বাস্তবে এই ধারণাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।

প্রকৃতপক্ষে, ইসলামসহ কোনো ধর্মই চক্ষুদান বা অঙ্গদানকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং যদি কারো দৃষ্টি ফিরে আসে, এটি সওয়াবের কাজ। মৃত্যুর পরও জীবন্ত এক দান—এটাই চক্ষুদান। আমাদের সমাজে কুসংস্কার এখনও প্রচলিত। মানুষ ভেবে বসে অঙ্গদান মানে নাকি পরকালে ক্ষতি হবে বা মৃতদেহ বিকৃত হবে। কিন্তু এগুলো অজ্ঞানতার ফল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত, কর্নিয়া সংগ্রহের সময় মৃতদেহে কোনো বিকৃতি ঘটে না; চোখের সৌন্দর্যও নষ্ট হয় না। বরং সেই দেহ মানবতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অঙ্গদান একটি সওয়াবের কাজ। নবী করিম (সা.)-এর শিক্ষা হলো—মানুষের উপকার করা সর্বোত্তম কাজ। সুতরাং রক্তদান ও চক্ষুদান উভয়ই মানবতার পথে চলার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

সরকার ২০১৭ সালে ২ নভেম্বরকে “জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস” ঘোষণা করে। এই দিবস মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ায়, রক্তদাতাদের উৎসাহিত করে এবং মৃত্যুর পর চক্ষুদানের প্রতিশ্রুতি গ্রহণকে সহজ করে। দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য সংগঠন এই মহান কর্মে যুক্ত—যেমন: জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি, বিডি ব্লাড, ব্লাড ম্যান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চোখের আলো ফাউন্ডেশন, লাইফসেভারস। এরা নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প, কর্নিয়া সংগ্রহ কার্যক্রম ও সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে মানবতার আহ্বান—“আজ আমি রক্ত দিলাম, আপনি কবে?”—এটাই পরিবর্তনের সূচনা।

আজ প্রযুক্তির কারণে রক্তদান আরও সহজ হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ ও সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে দাতা খুঁজে পাওয়া যায়। একইভাবে চক্ষুদান প্রতিশ্রুতিও ডিজিটালভাবে নিবন্ধন করা যায়। জাতীয় ডেটাবেইস থাকলে জরুরি অবস্থায় দ্রুত সাড়া পাওয়া সম্ভব। প্রযুক্তির এই ব্যবহার মানবতার সেবায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

তরুণ প্রজন্মই রক্তদান ও চক্ষুদান আন্দোলনের প্রাণশক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, স্কুল বা মাদ্রাসায় নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প ও চক্ষুদান সচেতনতা কর্মসূচি থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও উদার, দানশীল ও মানবিক হয়ে উঠবে। এক ফোঁটা রক্ত কিংবা মৃত্যুর পর দুটি চোখ দান করা মানে দুটি জীবনকে আলোয় ফিরিয়ে দেওয়া। যখন মানুষ এই অনুভূতি বুঝবে, তখন বাংলাদেশ অন্ধকারমুক্ত মানবতার দেশ হয়ে উঠবে।

রক্তদাতা হয়তো কখনো জানবেন না, তার রক্তের ফোঁটায় কোনো মায়ের কোল ভরে গেছে, কোনো শিশুর প্রাণ বেঁচেছে, অথবা কোনো রোগী নতুন জীবন পেয়েছেন। চক্ষুদাতা হয়তো দেখবেন না, কিন্তু তাঁর চোখে কেউ প্রথমবার সূর্যোদয় দেখছে, সন্তানের মুখ চিনছে বা বই পড়ছে। এই আনন্দ কোনো বস্তু দিয়ে মাপা যায় না—এটি হৃদয়ের অনুভূতি, মানবতার শুদ্ধতম প্রকাশ।

মানবতার সেবা মানে শুধু দুঃখে সহানুভূতি দেখানো নয়; কাজের মাধ্যমে অন্যের জীবন বদলে দেওয়া। রক্তদান ও চক্ষুদান এমনই এক সেবা, যা মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে অন্যের জীবনে আলো জ্বালায়।

জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের জীবন রক্ষার চেয়ে বড় দান নেই। যদি প্রতিটি মানুষ এই চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের মানবতার দেশ—যেখানে কেউ রক্তের অভাবে মরবে না, কেউ অন্ধত্বে অন্ধকারে থাকবে না। আসুন, আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি—“বাঁচার সময় রক্ত দেব, মৃত্যুর পর চোখ দিয়ে যাব পৃথিবীতে আলো ছড়ানোর উত্তরাধিকার।” মানুষের বাঁচানোই মানবতার শ্রেষ্ঠ দান, আলো ছড়ানোই জীবনের সত্য মান।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কলাম লেখক ও প্রবন্ধকার, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০১ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test