E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

বিলুপ্তির পথে পঞ্চগড়ের ধামের গান!

২০২৫ নভেম্বর ০৩ ১৮:৪০:০৮
বিলুপ্তির পথে পঞ্চগড়ের ধামের গান!

রহিম আব্দুর রহিম


মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যা কিছুই করেন তাই তাঁর সংস্কৃতি। আর সুন্দর ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা অনিবার্য হয়ে পড়ে তাই তার ‘সাংস্কৃতি’, যার প্রতিচ্ছবি, রূপ, রস, জীবনাচরণ পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে সংগৃহিত হয়। যেখানে দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা, চাওয়া-পাওয়া গ্রন্থিত হয় নিজস্ব আদলে। সাংস্কৃতিহীন জাতি সভ্যতা পরিপন্থী, আর সংস্কৃতিহীন জাতি অচল-অথর্ব। প্রত্যেক জাতিরই স্ব-স্ব-ধর্ম-কর্ম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার সংস্কৃতি। বাঙালি জাতির সাংস্কৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ। জাতিগতভাবে আমাদের নিজস্ব যে আচার-আচারণ, উৎসব রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির মাঝে ততটা বিরাজমান নয়।

দেশের প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের লোকজ সাংস্কৃতি। এর মধ্যে দেশের উত্তর সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের লোকজ সাংস্কৃতি ধামের গান অন্যতম। গ্রামীণ জীবনের জনপ্রিয় ধামের গান বছরব্যাপী চলে। তবে আশ্বিনের দুর্গাপূজায়, কার্তিকের লক্ষ্মীপূজা ও অমাবস্যায় কালীপূজা উপলক্ষ্যে ধামের গানের আসর বসে। শুধু তাই নয়, অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড়ের ধামের গানে প্রাণ ফিরে আসে। এই গানের বড় বৈশিষ্ট্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ জীবনের বাস্তবতা নিয়ে সৃষ্ট পালার কোন স্ক্রীপ্ট নেই। একেবারে কথ্য ভাষায় নির্মিত আসরে হাজার-হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বয়ো-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণীদের ঢল নামে। ‘ধাম’ মানে বারান্দা বা ঘর। ধামের গান মানে ঘরের গান। যে গান গ্রামের গাছতলা, বাড়ির আঙিনা কিংবা উঁচু মাটির ঢিবি তৈয়ার করে পরিবেশিত হয়। কোন কোন এলাকায় এই ধাম রংপাচালী এবং মানপাচালী নামে পরিচিত।

অভিনেতাদের বেশিরভাগই গ্রামের খেঁটে খাওয়া অশিক্ষিত জন-মানুষ। পুরুষরা এমনভাবে নারী সাজেন, কোনভাবেই তাদের চেনা যায় না যে, পুরুষ নারী সেজেছেন। পরনে শাড়ী, মাথায় লম্বা চুল, খোঁপা, নাকে নাকফুল, কানে দুল, গলায় হার এক অদ্ভুদ কান্ড। গ্রামীণ জীবনের নানা কাহিনী নিয়ে সৃষ্ট পালা নাচে-গানে রসে-জসে পরিপূর্ণ। আবার কোন কোন পালায় ব্যঙ্গরস, হাস্যরস, করুণরস, বীররসে মিশ্রিত অপূর্ব ঘটনার অবতারণ ঘটে। শুধু পূজা-পার্বণ বা নবান্ন উপলক্ষ্যে আসর বসে তা কিন্তু নয়। গ্রামীণ সমাজের লোকাচার বিবাহ বিচ্ছেদ রোধ, জ্বীন-ভূত এর আছর থেকে মুক্তি, পুত্র সন্তান কামনা, রোগ ব্যাধি দূর করার জন্য মানত হিসেবে এই গানের আসর বসানো হতো।

জেলার পাঁচটি উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়নের প্রায় ৫ শতাধিক স্থানে একসময় পর্যায়ক্রমে নিয়মিত ধামের আসর বসতো। শত বছর পূর্ব থেকে চলে আসা পঞ্চগড়ের ধামের আসর জন-মানুষের দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-প্রীতি ভালবাসার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রবাহমান। ধামের কাহিনী লৌকিক হলেও যার স্ক্রীপ্ট রাইটারদের কোন হদিস এখনও পাওয়া যায়নি। কেউ তাদের খোঁজারও চেষ্টা করেনি।

সম্প্রতি ধামের গানের ষাটোর্ধ্ব অভিনেতা দেবীগঞ্জের পুলিন চন্দ্র এবং আটোয়ারী উপজেলার হরিশ চন্দ্র এর সাথে কথা বলে জানা গেছে- গ্রামীণ জীবন নির্ভর বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে হাস্যরসাত্মক ধামের পালার মধ্যে ‘প্যাঁচকেটার সংসার’, ‘বিধুবার গায়ে হলুদ’, ‘বউমার মিসকল’, ‘চেংরির মাথায় ডিমান্ড’, ‘লালচে বুড়া ঝাকালী সরী’, ‘অঘা বেটি বোতল চোষা’, ‘লালচে কোয়ালী কুনসুম গোসাই’, ‘বাপের শেষ বিয়ে’, ‘কায় কি কহুক মাইয়া লাগবে মোক’, ‘হাউসের বিহাই-অঙ্গিলা বেহানী’, ‘হিরাসরি আজলা’, ‘আম্বলসরি পিছলা বাউদিয়া’, ‘জলসরি জুলুম আলসিয়া’, ‘পাসকরা কামাইল’, ‘সাইকেল সরি হেন্ডেল বাউদিয়া’, ‘চালাকি সরি থুবরা গুছা’, ‘১০ নাম্বার আড়ি’, ‘আকুথাকু অধিকারী’, সোজামূত্রাসহ অসংখ্য ধামের পালা পঞ্চগড়ে যুগ যুগ ধরে পরিবেশিত হয়ে আসছে।

পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক ভাষার সাথে মিশ্রণ ঘটেছে সীমান্তবর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর এবং জলপাইগুড়ির আঞ্চলিক সংলাপের। ফলে ধামের পালার কাহিনী রস-জসের ভিন্নতায় নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে। ধামের গানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- সমাজের সকল প্রকার অবক্ষয়, অন্যায়, অনাচার পালায় অকপটে শৈল্পিক কায়দায় উঠে এসেছে। এক সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শাস্ত্রানুযায়ী নির্মিত ধামের আসর কালের ঘূর্ণায়নে সর্বজনীন হয়ে উঠলেও বর্তমানে তা বিলুপ্তির পথে। এখন আর আগের মত ধামের গানের আসর পঞ্চগড়ে বসছে না। এ আসর যে শুধুই পঞ্চগড়ের লোকজ সাংস্কৃতি তা নয়! এই শিল্পের সাথে জেলা তথা উত্তরাঞ্চলের কয়েক হাজার গ্রামীণ শিল্পী, কলা-কুশলীদের জীবন-জীবিকার অন্যতম পাথেয়।

লেখক: নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৪ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test