E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

প্রতিটি শ্বাসের সুরক্ষায় সচেতন হোন আজই

২০২৫ নভেম্বর ১২ ১৭:৩৫:১৮
প্রতিটি শ্বাসের সুরক্ষায় সচেতন হোন আজই

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


১২ নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস ২০২৫। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য—নিউমোনিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধে উদ্যোগ জোরদার করা। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যান। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৫ হাজারেরও বেশি শিশু এই রোগে মৃত্যুবরণ করে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের নিচের শিশু ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্করা সবচেয়ে ঝুঁকিতে।

নিউমোনিয়া কী

নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের একটি গুরুতর সংক্রমণ,যেখানে ফুসফুসের ক্ষুদ্র বায়ুথলি ফুলে গিয়ে তরল বা পুঁজে পূর্ণ হয়। ফলে শরীরে যথেষ্ট অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে না, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এই রোগ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাক দ্বারা হতে পারে। শ্বাস, হাঁচি, কাশি বা দূষিত বাতাসের মাধ্যমে জীবাণু সহজেই একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

রোগের ইতিহাস

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে নিউমোনিয়া নতুন কিছু নয়। প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস প্রায় ২৫০০ বছর আগে এ রোগের বর্ণনা দিয়েছেন। তবে আধুনিক যুগে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পরও এই রোগ বিশ্বের অন্যতম মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ সংক্রমণ হিসেবে রয়ে গেছে।বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে এটি শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ।

প্রধান কারণ

নিউমোনিয়ার মূল কারণ হলো জীবাণু সংক্রমণ, তবে আরও কিছু ঝুঁকি-উদ্দীপক কারণ রয়েছে—

ভাইরাস (যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, RSV, করোনা ভাইরাস)

ব্যাকটেরিয়া (বিশেষ করে Streptococcus pneumoniae)

ছত্রাক (দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার রোগীদের মধ্যে)

ধোঁয়া, ধুলাবালি বা কয়েলের ধোঁয়া শ্বাস নেওয়া

শীতল ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা

অপুষ্টি, ভিটামিন ও প্রোটিনের ঘাটতি

শ্বাসযন্ত্রের পূর্ববর্তী সংক্রমণ বা হাঁপানি

দীর্ঘমেয়াদি ধূমপান ও ফুসফুসের দুর্বলতা

প্রকারভেদ

চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিউমোনিয়াকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়—

১️. সমাজে সংক্রমিত নিউমোনিয়া (Community-acquired): ঘরে বা কর্মস্থলে সংক্রমণ হয়।

২️. হাসপাতালে সংক্রমিত নিউমোনিয়া (Hospital-acquired): হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে দেখা দেয়।

৩️. অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া: খাবার, পানি বা বমি শ্বাসনালিতে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায়।

৪️. দুর্বল প্রতিরোধক্ষমতার নিউমোনিয়া: ক্যান্সার বা এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

উপসর্গ

নিউমোনিয়ার উপসর্গ বয়স, জীবাণুর ধরন ও রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
তবে সাধারণভাবে লক্ষণগুলো হলো। * উচ্চ জ্বর ও কাঁপুনি * কাশি (শুকনো বা কফসহ) * বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট * দ্রুত বা ভারী শ্বাস-প্রশ্বাস * মাথা ব্যথা, অবসাদ, ঘুমঘুম ভাব * ক্ষুধামন্দা বা বমি। বয়স্কদের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি বা মানসিক অস্পষ্টতা

শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষণ:

* শ্বাসের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া * বুক দেবে যাওয়া বা ফুলে ওঠা * নিস্তেজ ভাব ও খাওয়াতে অনীহা

ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী

নিউমোনিয়া যে কারও হতে পারে, তবে কিছু মানুষ এতে বেশি ঝুঁকিতে থাকে—

* পাঁচ বছরের নিচের শিশু * ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক * হাঁপানি, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি * অপুষ্ট শিশু * ধূমপায়ী ও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার * যারা ঠান্ডা ও দূষিত পরিবেশে কাজ করেন দুর্বল প্রতিরোধক্ষমতার রোগী (এইডস, ক্যান্সার, কিডনি রোগ ইত্যাদি) এই গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য প্রতিরোধ ও টিকাদান বিশেষভাবে জরুরি।

রোগ নির্ণয়

নিউমোনিয়ার সন্দেহ হলে চিকিৎসক রোগীর ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা করেন।

* স্টেথোস্কোপে অস্বাভাবিক শব্দ পাওয়া গেলে এক্স-রে বা রক্ত পরীক্ষা করা হয়।

* কফ পরীক্ষা করে জীবাণুর ধরন নির্ধারণ করা হয়।

* রোগীর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করেও সংক্রমণের তীব্রতা বোঝা যায়।

জটিলতা

সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে নিউমোনিয়া গুরুতর জটিলতায় রূপ নিতে পারে—

* ফুসফুসে পানি বা পুঁজ জমা (Pleural effusion, Empyema)

* ফুসফুসে ফোঁড়া (Lung abscess)

* সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে পড়া (Septicemia)

* শ্বাসকষ্টজনিত ব্যর্থতা (Respiratory failure) এই জটিলতাগুলো বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য প্রাণঘাতী।

প্রতিরোধই সেরা উপায়

নিউমোনিয়া প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে অনেক সহজ ও কার্যকর। প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো হলো—

১️. টিকা: শিশুদের নিউমোকক্কাল (PCV) ও হিব (Hib) টিকা সময়মতো দিতে হবে।

২️. বুকের দুধ: অন্তত ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো জরুরি।

৩️. পুষ্টি: পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা দরকার।

৪️. পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত হাত ধোয়া, খাবার ঢেকে রাখা ও পরিস্কার পানি পান।

৫️. ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ: রান্নাঘর ও ঘর ধোঁয়া-মুক্ত রাখা।

৬️. ধূমপান ত্যাগ: এটি শ্বাসযন্ত্র দুর্বল করে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

৭️. শীত প্রতিরোধ: শিশু ও বৃদ্ধদের ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

বাংলাদেশে নিউমোনিয়ার প্রকোপ এখনো উদ্বেগজনক। বিশেষ করে বায়ুদূষণ, জনবসতি, অপুষ্টি, ঘনবসতিপূর্ণ বসবাস ও টিকাদানে ঘাটতি এ রোগকে আরও বিস্তার ঘটাচ্ছে। সরকারি টিকাদান কর্মসূচির ফলে শিশুমৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে,তবে এখনও অনেক অভিভাবক টিকার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত নন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সচেতনতা ও টিকাদানের হার বাড়াতে পারলে বাংলাদেশে নিউমোনিয়াজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।

করণীয় সচেতনতা

নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধুমাত্র চিকিৎসকের দায়িত্ব নয়; এটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সবার সম্মিলিত সচেতনতার ফল। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের টিকা ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা চালু করা যেতে পারে। কর্মস্থল ও বাসায় বায়ু চলাচল ও আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা জরুরি। গণমাধ্যমে নিউমোনিয়া বিষয়ে নিয়মিত প্রচারণা দরকার, যাতে জনগণ নিজ দায়িত্বে সতর্ক হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি গুরুতর সমস্যা। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় এই রোগের উপসর্গ ও রোগীর শারীরিক গঠন অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করা হয়। এতে শরীরের ভেতরের প্রতিরোধশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং প্রাকৃতিকভাবে ফুসফুসের প্রদাহ, কফ ও শ্বাসকষ্ট কমে আসে। হোমিওপ্যাথির বিশেষত্ব হলো— এটি রোগকে দমন না করে মূল থেকে আরোগ্যের চেষ্টা করে। রোগের স্তর, প্রকৃতি ও রোগীর ব্যক্তিগত অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে সঠিক ঔষধ নির্ধারণ করা হয়।

নিউমোনিয়ায় প্রমাণিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ হোমিও ঔষধ ও তাদের গুণ নিচে দেওয়া হলো— আকোনাইট, হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে পড়ে নিউমোনিয়া শুরু হলে এটি সবচেয়ে কার্যকর। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা ও বুক জ্বালাপোড়া থাকলে আকোনাইট দ্রুত আরাম দেয়। এটি ফুসফুসের প্রদাহের প্রাথমিক পর্যায়ে দারুণ কাজ করে। ব্রায়োনিয়া, শুষ্ক কাশি, সামান্য নড়াচড়ায় বুকের ব্যথা বেড়ে যাওয়া এবং কফ উঠতে কষ্ট হলে ব্রায়োনিয়া অসাধারণ উপকারী। এটি ফুসফুসের প্রদাহ কমিয়ে কফ বের হতে সাহায্য করে।ফসফরাস, দুর্বলতা, রক্তমিশ্রিত কফ ও বুক জ্বালাপোড়া থাকলে ফসফরাস অমূল্য।

এটি ফুসফুসের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে এবং রোগীর শক্তি ফিরিয়ে আনে। অ্যান্টিমন টারটার, যখন কফ বুকের ভেতরে জমে থাকে কিন্তু উঠতে চায় না, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তখন এই ঔষধ দারুণ ফল দেয়। এটি কফ পরিষ্কার করে শ্বাস-প্রশ্বাস সহজ করে। ক্যালি কার্ব, বয়স্ক ও দুর্বল রোগীর নিউমোনিয়ায় বিশেষভাবে কার্যকর। ভোরের দিকে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে ও কফ উঠতে দেরি হলে ক্যালি কার্ব উপকারী। সালফার, যেসব রোগীর নিউমোনিয়া বারবার ফিরে আসে বা আগের চিকিৎসায় পুরোপুরি সারে না, সালফার তাদের জন্য উপযোগী। এটি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা জাগিয়ে তোলে। লাইকোপোডিয়াম, ডান দিকের ফুসফুস আক্রান্ত হলে বা দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা ও গ্যাসের সমস্যা থাকলে লাইকোপোডিয়াম উপকারী। এটি রোগীর শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ফুসফুসের কর্মক্ষমতা উন্নত করে। তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সঠিক ওষুধ ও ডোজ নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করলে নিউমোনিয়া থেকে দ্রুত ও স্থায়ী আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।

পরিশেষে বলতে চাই, নিউমোনিয়া কোনো সাধারণ ঠান্ডা নয়, এটি ফুসফুসের এক প্রাণঘাতী সংক্রমণ যা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে এটি শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেনের ঘাটতি এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। তাই এর প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়। নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, ধূমপান পরিহার করা, পর্যাপ্ত ঘুম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ—এসব অভ্যাস শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শিশুদের টিকা দেওয়া ও বয়স্কদের নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন নেওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিটি শ্বাসই জীবনের প্রতীক। সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, টিকা ও সঠিক জীবনযাপন—এই চার অস্ত্রেই আমরা নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১২ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test