E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

এ চুক্তি ক্ষতিকর, এ চুক্তি সার্বভৌমত্ব বিরোধী

২০২৫ নভেম্বর ২০ ১৯:৫২:৪১
এ চুক্তি ক্ষতিকর, এ চুক্তি সার্বভৌমত্ব বিরোধী

রিয়াজুল রিয়াজ


আমরা সবাই অবগত হয়েছি যে, গত ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার টার্মিনাল—চট্টগ্রামের লালদিয়া ও রাজধানীর কেরানীগঞ্জের পানগাঁও—বিদেশি অপারেটরদের কাছে হস্তান্তরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলেছে। এদিন একদিকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ের বিচারকার্য পরিচালনায় ঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়, অপরদিকে ধানমণ্ডি ৩২ এ বুলডোজার নিয়ে বঙ্গবন্ধু'র পোড়া ও ভাঙা বাড়িটির অবশিষ্ট অংশ ভাঙতে কথিত ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং একই সাথে নীরবে ইউনূস  সরকার ও বিদেশিদের কাছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুইটি কনটেইনার টার্মিনাল হস্তান্তরের চুক্তি স্বাক্ষর। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে এটি প্রধান বন্দর অবকাঠামো দীর্ঘ মেয়াদি লিজে বিদেশি কোম্পানির কাছে যাওয়ার প্রথম ঘটনা। ইউনূস এদিক দিয়ে রেকর্ড করলেন বটে।

যা হোক, এটি ডেনমার্কভিত্তিক এপি মোলার-মায়েরস্কের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস বিএভি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সঙ্গে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি করেছে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য, যা একটি বড় পিপিপি প্রকল্প। পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন ভায্যমতে, কোম্পানিটি প্রথম তিন বছরে নির্মাণ, সরঞ্জাম সাপ্লাই ও সংশ্লিষ্ট কাজে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করবে। সাইনিং মানি হিসেবে এপিএম টার্মিনালস ২৫০ কোটি টাকা দেবে। অথচ নিজস্ব আয়োজনে দেশের প্রচলিত বন্দর ব্যবস্থাপনায় ইনকাম হতে পারে এর থেকে বেশি যা দেশের জন্য নিরাপদও বটে।

তাহলে খুব সহজেই জনসাধারণের মনে প্রশ্ন জাগছে দেশের স্বার্থ বিনষ্ট ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকিতে ফেলে এসব গোপন চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বন্দরের সাতটির মধ্যে পাঁচটি টার্মিনালই বিদেশিদের হাতে কেনো তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? লালদিয়া চর কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণ ও পরিচালনা চুক্তি হয়েছে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস এর সঙ্গে। এই চুক্তিটি হয়েছে ৪৮ বছর দীর্ঘ মেয়াদি (১৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ)। চুক্তি মোতাবেক বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কী পরিমাণ ট্যারিফ, মাশুল, চার্জ, শুল্ক-কর ইত্যাদি পাবে, সেই বিষয়াবলি সম্পূর্ণ গোপন রেখেই চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। তাছাড়া বহুল আলোচিত ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার জন্য আবুধাবি ভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গেও প্রায় ৪০ বছর মেয়াদি চুক্তির তোড়জোড় চালাচ্ছে সরকার। একটা অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের মেয়াদকাল মাত্র ১৮ মাস, তাদেরকে বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ৪৮ বছর বা ৪০ বছর এর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার অধিকার কে দিয়েছেন, জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ইউনূস সরকারের মূল এজেন্ডা কি বিদেশিদের স্বার্থ উদ্ধার করা? এসব প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে সারাদেশে।

বুধবার দুপুরে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলীতে কয়েকজন ৬০-৭০ বছরের মুরুব্বি ধাঁচের ভদ্রলোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চুক্তি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছিলেন। একজন বলছিলেন, সবাই মুখ বন্ধ রাখলে তো ধীরে ধীরে দেশটাই বিক্রি করে দিবে মনে হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? আরেকজন রশিকতা করে বললেন, সারা বিশ্বকে 'টুপি' পড়ানো মানুষটি; নিজ দেশের সাধারণ মানুষকেও 'টুপি' পড়াতে বাদ রাখছেন না! ষাটোর্ধ্ব ওই ব্যক্তিটি প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূসের কঠোর সমালোচক বলেই মনে হলো। তিনি ইউনুস সরকারের বন্দর চুক্তি সম্পর্কে বলেন, 'ইউনূস স্যার তাঁর এই গোলামীর গোপন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্যতম বন্দর ব্যবস্থাপনা ও দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দিচ্ছেন নাতো, দেশবাসীকে এসব ভাবতে হবে!'

যা হোক, কতজনে কতকথাই বলছেন। তবে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, আমরা লালদিয়া ও পানগাঁও বন্দরের দুটি চুক্তি সই করেছি। এসব চুক্তির অংশ হিসেবে আমাদের ওই কোম্পানিগুলোকে ১০ বছরের জন্য ১০০% করমুক্ত সুবিধা দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে কর্মরত বিদেশি টেকনিক্যাল স্টাফও করমুক্ত সুবিধা পাবেন। এছাড়া তাদের (কোম্পানিগুলোর) রয়্যালটি, টেকনিক্যাল নলেজ ফি, লভ্যাংশ—সবকিছুই এখন করের আওতামুক্ত।’ এমন বাহ্যিক অনেক বিষয় সম্মুখে আনলেও চুক্তির গোপনীয় প্রকাশ প্রকাশ করছে না সরকার! আর এতেই জনগণের ক্ষোভ আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বাড়ছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনও। ওই প্রসংগে পরে আসছি।

এদিকে, 'দেশে তলে তলে অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে' বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘ইউনূস সাহেব (অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) ধরা পড়ে গেছেন। (তার) আসল এজেন্ডা হলো চট্টগ্রাম বন্দর, তিনি তলে তলে আমেরিকান কোম্পানির কাছে বন্দর লিজ দিয়ে দিচ্ছেন, পশ্চিমা কোম্পানির কাছে।’

সম্প্রতি একটি সমাবেশে এসব কথা বলেন সিপিবির বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠানোর নামে মানবিক করিডর করার চেষ্টা করছেন। আমেরিকার সেনাবাহিনী যাতে এখানে এসে ষড়যন্ত্র কার্যকর করতে পারে, সেই চেষ্টা করছেন।’ তিনি বলেন, ‘দেশবাসীর উদ্দেশে আমি বলতে চাই—হুঁশিয়ার থাকবেন। বাংলাদেশকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে চেষ্টা হচ্ছে, সেটাকে আমাদের প্রতিহত করতে হবে।

বৈষম্য দূর করতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হলেও কিছুই করা হয়নি মন্তব্য করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘৫৪ বছর আগে ৩০ লাখ মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে পাকিস্তানের গোলামি থেকে মুক্ত হয়েছি। নতুন করে যদি কেউ আমাদের ভারত কিংবা আমেরিকার গোলামির শিকলে বাঁধতে চায়, তাহলে মানুষ আবার জেগে উঠবে। মুক্তির সংগ্রাম ধ্বংস করার কোনো চক্রান্ত বরদাশত করা হবে না।’

এছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ও কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়ায় সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তা চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশিদের দেওয়ার প্রতিবাদে রাজপথে বিক্ষোভ-সমাবেশ চলমান রয়েছে। বন্দর রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করেছে দেশের সব শ্রমিক সংগঠনও।

শুরু থেকে দেশের বামপন্থী দলগুলো দীর্ঘদিন আন্দোলন অব্যাহত রাখলেও এবার মাঠে নামছে ডানপন্থী সংগঠনগুলোও। দাবি আদায়ে আগামী সপ্তাহেই হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি বড় অংশের। দেশের বন্দর রক্ষার এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও। গোপন চুক্তি করে দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশি কম্পানির হাতে বন্দর তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে বুধবার বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। বিকেল সাড়ে ৪টায় ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।

এদিকে, গত সোমবার ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে লালদিয়ার চর কনটেইনার টার্মিনাল এবং সুইজারল্যান্ডের মেডলগ এসএর সঙ্গে পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি হওয়ার পর আরো টার্মিনাল হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৪৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে হস্তান্তরের কথা রয়েছে। এনসিটিতে আদালতের মৌখিক স্থিতাবস্থা থাকা সত্ত্বেও বন্দর কর্তৃপক্ষ চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে গত ১৬ নভেম্বর সাত সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুব আলম তালুকদারকে। এনসিটি হস্তান্তর প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন। ব্যারিস্টার মো. আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, গত ১২ নভেম্বরের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে আশ্বাস দিয়েছিল, রিটের শুনানির আগে তারা (বন্দর কর্তৃপক্ষ) নতুন পদক্ষেপ নেবে না। কি তা মানা হয়নি, এটাকে অনেকেই দেখছেন 'আদালত অবমাননার শামিল' হিসেবে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে বারবার কথা বলেছেন। তবে জনগণের প্রতিবাদের মুখে এক পর্যায়ে এটি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হন সেনা প্রধানও। বন্দর ও করিডোর কিছুতেই বিদেশিদের হাতে দিতে দেওয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এসময় সেনা প্রধানের 'নো ব্রাডি করিডোর' কথাটি বেশ জনপ্রিয়তাও পায়। তারপর কিছুদিন বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি বন্দর হস্তান্তরের কাজে অস্বাভাবিক গতি বাড়ায় সরকার। এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই আন্দোলন করে আসছে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। সম্প্রতি দেশের পাঁচটি টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়ার আলোচনা সামনে আসে। গত সোমবার লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনালের বিষয়ে দুই বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তির পর প্রবল আপত্তি তুলছে বিভিন্ন সংগঠন। গোপনে তড়িঘড়ি করে ৩৩ বছর মেয়াদি চুক্তির এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের অনেকেই।

বন্দর চুক্তি নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, এ চুক্তির ফলে বন্দরের টার্মিনাল ব্যবহারের সব নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কম্পানির হাতে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের মোট সাতটি গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালের পাঁচটিই বিদেশি অপারেটরদের দ্বারা পরিচালিত হতে যাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে দ্রুততার সঙ্গে এসব চুক্তি করা এবং চুক্তির বিষয়গুলো প্রকাশ না করায় সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি বন্দরের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিচালনায় বিদেশি কম্পানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তারা আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, গণসংযোগ, গণ-অনশন, গণমিছিল ও মশাল মিছিলের মতো কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলসহ দেশের ক্রিয়াশীল অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠনের জোট ‘শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)’, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলো, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাসদ, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, পাঁচদলীয় বাম জোট এবং উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ছাত্র-যুব সংগঠন। টার্মিনাল ইজারা চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামীও।

এছাড়া, গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে বিশাল মশাল মিছিল করেছে ‘চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পরিষদ’। বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠন। আগামী শনিবার চট্টগ্রামে জাতীয় কনভেনশন আহবান করেছে স্কপ। কনভেনশন থেকে হরতাল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। চট্টগ্রাম স্কপের যুগ্ম সমন্বয়ক রিজওয়ানুর রহমান খান বলেন, শ্রমিক-কর্মচারী, ব্যবসায়ীসমাজ ও দেশের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে গণবিরোধী ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত চুক্তি জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে। স্টেকহোল্ডারদের মতামত ছাড়াই এই দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চুক্তি করা হয়েছে। তাই স্কপ এই ইজারা চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। অবিলম্বে চুক্তি বাতিল না করলে আগামী শনিবার চট্টগ্রামে শ্রমিক কনভেনশন থেকে হরতাল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড অবরোধসহ কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। স্কপ ঘোষিত সব আন্দোলন কর্মসূচি সফল করতে বাম গণতান্ত্রিক জোট সর্বশক্তি নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছেন জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।

তিনি বলেন, আগামী রবিবার সারা দেশে বিক্ষোভ, গণসংযোগ, পদযাত্রার কর্মসূচি রয়েছে স্কপের কনভেনশনে নতুন কর্মসূচি আসবে। সরকার দাবি না মানলে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও এবং প্রয়োজনে লাগাতার হরতাল কর্মসূচি দেওয়া হবে। স্কপের নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা সাইফুল হক। তিনি বলেন, শর্ত গোপন রেখে ও জনগণের নানা অংশের মতামত উপেক্ষা করে যেভাবে চুক্তি করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারও স্বৈরাচারী সরকারগুলোর পথে হাঁটছে। যে সরকারের বয়স মাত্র তিন মাস আছে, সেই সরকারকে কেন প্রবল বিরোধিতা ও বিতর্কের মধ্যে এই চুক্তি করতে হবে?

সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, 'মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে লালদিয়া ও পানগাঁও নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির মধ্য দিয়ে সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হয়ে কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে আমরা আমাদের প্রতিবাদ জারি রেখেছি। এসব চুক্তি শুধু ক্ষতিকর নয়, স্বার্বভৌমত্ববিরোধী। গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার এসব চুক্তি বাতিলে বাধ্য হবে।'

এমতাবস্থায়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করা বা করতে চাওয়া দেশের এমন স্পষ্টকাতর বিষয় নিয়ে দেশের মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, বাড়ছে আন্দোলন, বড় হচ্ছে বন্দর রক্ষায় মাঠে নামা বিক্ষোভকারীদের মিছিল। এখন দেখার বিষয় এ মিছিলটি কতো বড় হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের টনক নড়ে, বাতিল ও বন্ধ করে বিদেশিদের হাতে বম্দর হস্তান্তরের চুক্তি। নাকি 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার' প্রক্রিয়ায় বিদেশের কাছে চলে যাবে আমাদের বন্দর ব্যবস্থাপনার ভাগ্য, দেশের জনগণের ভবিষ্যত? এমন নানা প্রশ্নে জর্জরিত বাংলাদেশ। আর এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে চলমান আন্দোলনের গতিপথ, হাইকোর্টে চলমান এ বিষয়ক রিটের নিষ্পত্তি ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মনোভাবের ওপর। তবে দেশের এসব বন্দর বিশেদিদের হাতে গেলে তা যে শুধু দেশের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনবে তা নয়, হুমকিতে পড়বে দেশের সার্বভৌমত্বও।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ছড়াকার।

পাঠকের মতামত:

২০ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test