E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

দক্ষিণ এশিয়ার সবুজ জ্বালানি রাজনীতি: কার্বন ক্রেডিট থেকে জলবায়ু ন্যায়বিচার

২০২৫ নভেম্বর ২৪ ১৯:০২:৫৭
দক্ষিণ এশিয়ার সবুজ জ্বালানি রাজনীতি: কার্বন ক্রেডিট থেকে জলবায়ু ন্যায়বিচার

মো. ইমদাদুল হক সোহাগ


বিশ্বের জ্বালানি রাজনীতিতে বড় ধরনের পালাবদল ঘটছে। ক্ষমতার মাপকাঠি এখন আর কার দখলে কত তেল-গ্যাস আছে, তার ওপর নির্ভর করে না; নির্ভর করে—কে কার্বন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ওপর। কার্বন নিঃসরণ এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন ‘মুদ্রা’। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে কার্বন প্রাইসিং বা কার্বন মূল্যায়ন থেকে বৈশ্বিক রাজস্ব ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ নিঃসরণ এখন বিভিন্ন মূল্যায়ন কাঠামোর আওতায় এসেছে। এটি প্রমাণ করে, প্রভাব বিস্তারের নতুন মঞ্চ এখন ‘কার্বন গভর্নেন্স’।

কার্বন বাজারকে ঘিরে আর্থিক বিশ্বের আগ্রহ দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশকে স্বেচ্ছাধীন কার্বন বাজারের (Voluntary Carbon Market) আকার ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁতে পারে। কারণ, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ‘নেট-জিরো’ বা শূন্য নিঃসরণ প্রতিশ্রুতি পূরণে উচ্চমানের কার্বন অফসেট খুঁজছে। প্রশ্ন হলো—দক্ষিণ এশিয়া কি এই বাজারের নিয়ম দাতা হবে, নাকি কেবল দর্শক হয়ে থাকবে?

বৈশ্বিক নিঃসরণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবদান মাত্র ৮ শতাংশের মতো; অথচ জলবায়ু ঝুঁকির ক্ষেত্রে এই অঞ্চলই সবচেয়ে বিপন্ন। তাপপ্রবাহ, অনিয়মিত বর্ষা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা আর ঘন ঘন বন্যায় এ অঞ্চলের উন্নয়ন বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এই অঞ্চলের রয়েছে অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ—ম্যানগ্রোভ বন, নদী ব্যবস্থা, ট্রপিক্যাল অরণ্য এবং বিশাল নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা—যা বিশ্ববাজারে উচ্চমানের ‘কার্বন ক্রেডিট’ হিসেবে বড় মূল্য পেতে পারে।

বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই উদাহরণ তৈরি করেছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) দেশের সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচির মাধ্যমে দেখিয়েছে—কীভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প থেকে যাচাইযোগ্য নিঃসরণ হ্রাস করা যায়। আবার সুন্দরবন আমাদের জন্য ‘ব্লু কার্বন’ বাজারের দরজা খুলে দিয়েছে। এখন প্রয়োজন এই সফল মডেলগুলোকে বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া এবং দেশজুড়ে একটি মানসম্মত কাঠামো গড়ে তোলা।

বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ, নেপালের কমিউনিটি ফরেস্ট কিংবা শ্রীলঙ্কার রেইনফরেস্ট—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়া জীববৈচিত্র্য-সমৃদ্ধ উচ্চমানের ক্রেডিট দিতে সক্ষম। পাশাপাশি, এ অঞ্চলে মাথাপিছু নিঃসরণ কম হওয়ায় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি বা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করলে দ্রুত ফল পাওয়া যায়, যা বৈশ্বিক ক্রেতাদের জন্য আকর্ষণীয়।

কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে দরকার শক্তিশালী কাঠামো। বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলে জরুরি ভিত্তিতে একটি জাতীয় কার্বন রেজিস্ট্রি গঠন করতে হবে, যা প্যারিস সনদের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এতে ‘ডাবল কাউন্টিং’ বা দ্বৈত গণনা বন্ধ হবে এবং প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। পাশাপাশি গ্রিন বন্ড, কার্বন-লিঙ্কড আর্থিক পণ্য এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোর জন্য বিশেষায়িত অর্থায়ন আরও জোরদার করতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক (SAARC) বা বিমসটেক (BIMSTEC) কাঠামোর আওতায় একটি আঞ্চলিক ‘কার্বন এক্সচেঞ্জ’ গড়ে তোলা সম্ভব। এটি দামের অস্থিতিশীলতা কমাবে, যাচাই পদ্ধতি একীভূত করবে এবং বিনিয়োগকারীদের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে। এতে পুরো অঞ্চলটি একক শক্তি হিসেবে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কার্বন আয়ের সুফল যেন প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছায়। বননির্ভর জনগোষ্ঠী, উপকূলবাসী এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের শ্রমিক—যাঁরা জলবায়ু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত—তাঁদের হাতে সরাসরি আর্থিক সুফল পৌঁছাতে হবে। অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব আসবে না। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্বন অ্যাকাউন্টিং, জলবায়ু অর্থনীতি এবং পরিবেশ আইন বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।

জলবায়ু কূটনীতি এখন বাণিজ্যকেও প্রভাবিত করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম’ (সিবিএএম) রপ্তানিমুখী দেশগুলোর ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। চীনও তার জাতীয় নিঃসরণ বাণিজ্য ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করছে। তৈরি পোশাকসহ যেসব খাতে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে, তাদের দ্রুত জলবায়ুবান্ধব শিল্পনীতি গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই।
এর পাশাপাশি ‘দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা’ (South-South Cooperation) বাড়ানো জরুরি। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব বাড়ালে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে—বিশেষ করে কার্বন বাজার, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল ও প্রযুক্তি হস্তান্তর ইস্যুতে।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে কেবল জলবায়ু ঝুঁকির দেশ হিসেবে দেখা হয়েছে। ঝুঁকি আছে, কিন্তু সম্ভাবনাও বিশাল। উপকূলীয় অভিযোজন, কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি—এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার ‘জলবায়ু উদ্ভাবন ল্যাবরেটরি’। একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য কার্বন ক্রেডিট ইকোসিস্টেম গড়ে উঠলে আমাদের প্রাকৃতিক শক্তিকে অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।

আগামী শতকের ক্ষমতার মাপকাঠি এটা হবে না যে কে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি পোড়াল; বরং এটা হবে—কে কম নিঃসরণ করল, কে বেশি পুনরুদ্ধার করল এবং কে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারল। দক্ষিণ এশিয়ার সেই সক্ষমতা, সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আছে। এখন দরকার মানসিকতার পরিবর্তন—‘বাঁচার লড়াই’ থেকে ‘নেতৃত্ব দেওয়ার লড়াই’-এ উত্তীর্ণ হওয়া।

বাংলাদেশকে সেই রূপান্তরের সামনের সারিতেই থাকতে হবে—ঝুঁকির দেশ হিসেবে নয়, বরং একটি ‘কার্বন-স্মার্ট’ এবং জলবায়ু-সহনশীল ভবিষ্যতের স্থপতি হিসেবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

পাঠকের মতামত:

২৪ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test