আন্তর্জাতিক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূল দিবস: চাই নিরাপদ, সহিংসতামুক্ত সমাজ
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে নারী কেবল একজন মানুষই নন—তিনি সৃষ্টি, স্নেহ, ত্যাগ, শক্তি ও সভ্যতার ধারক। পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি—প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সভ্যতার বিকাশ সত্ত্বেও নারী আজও বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও সহিংসতার শিকার। শারীরিক, মানসিক, যৌন, সামাজিক, অর্থনৈতিক—বহুমাত্রিক সহিংসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ বহু নারী নীরবে কান্না গোপন করেন, যন্ত্রণা সহ্য করেন, জীবনভর লড়াই করে যান।
এ কারণেই প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর—নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণ আন্তর্জাতিক দিবস—বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা কেবল একটি পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংকট, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এই দিনটি নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য বৈশ্বিক সংগ্রামের প্রতীক।
২৫ নভেম্বর: হৃদয়বিদারক ইতিহাসের স্মরণ
এই তারিখটির শিকড় রয়েছে লাতিন আমেরিকার রক্তাক্ত ইতিহাসে। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিকান রিপাবলিকের তিন সাহসী বোন—প্যাট্রিয়া, মিনার্ভা ও মারিয়া মিরাবেল—স্বৈরশাসক রাফায়েল ট্রুজিলোর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা, প্রতিবাদ ও মানবাধিকার আন্দোলন তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর চোখে ছিল বিদ্রোহ। তাই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তিন বোনকে। কিন্তু মৃত্যু তাদের স্তব্ধ করতে পারেনি। বরং তারা হয়ে ওঠেন "Las Mariposas"—প্রজাপতির মতো স্বাধীনতার প্রতীক।
১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ তাদের স্মৃতিকে ধারণ করে ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে International Day for the Elimination of Violence Against Women। এই তিন নারীর ত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়— সহিংসতার বিরুদ্ধে নীরব থাকা অপরাধীকে শক্তিশালী করে, আর একটি প্রতিবাদই পারে সাম্রাজ্য কাঁপাতে।
নারীর প্রতি সহিংসতা: বহুমাত্রিক ও গভীর সংকট
নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি সমাজের গাঠনিক অসাম্য, সংস্কার, ভুল মূল্যবোধ ও বৈষম্যের ফল। এর রূপ বহুবিধ—
১. শারীরিক সহিংসতা: মারধর, আঘাত, অঙ্গহানি, গৃহ-সহিংসতা—এগুলো অনেক নারীর প্রতিদিনের বাস্তবতা। বাংলাদেশে অনেক নারী জীবনে অন্তত একবার শারীরিক সহিংসতার শিকার হন—এটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, সমাজের ব্যর্থতার নির্মম দলিল।
২. মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা: অপমান, ভয় দেখানো, হুমকি, চরিত্রহনন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা—এই সহিংসতার কোনো দাগ থাকে না, কিন্তু ক্ষত থাকে আত্মায় বছর ধরে। মানসিক সহিংসতা নারীর আত্মপরিচয়, স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাসকে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে দেয়।
৩. যৌন সহিংসতা: ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে জোরপূর্বক সম্পর্ক, মানবপাচার—এই সহিংসতা নারীজীবনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। রাস্তা, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র—সব জায়গায় নারীকে শঙ্কা নিয়ে চলতে হয়। যৌন সহিংসতা শুধু নারী নয়, পুরো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
৪. অর্থনৈতিক সহিংসতা: চাকরিতে বাধা, বেতন নিয়ন্ত্রণ, সম্পত্তির অধিকার অস্বীকার, আয় কেড়ে নেওয়া—নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত করাই অর্থনৈতিক সহিংসতার উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল নারী সহজেই নির্যাতনের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েন।
৫. সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতা : বাল্যবিবাহ, যৌতুক নির্যাতন, অ্যাসিড হামলা, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, প্রজনন অধিকার সীমাবদ্ধতা—এসব সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত সমস্যা। যে সমাজ নারীর স্বাধীনতাকে বাঁধা দেয়, সেই সমাজ নিজের উন্নয়ন পথও বন্ধ করে দেয়।
সহিংসতার গভীর কারণ: সমাজ কাঠামোর অসাম্য
১. পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা: নারীকে ‘দুর্বল’, ‘অধীনস্থ’ বা ‘অন্যের সম্পত্তি’ ভাবার ভুল ধারণা থেকেই সহিংসতার জন্ম। এই মানসিকতা পরিবার, শিক্ষা, ধর্মীয় ব্যাখ্যা, সংস্কৃতি—সবখানে ছড়িয়ে আছে।
২. শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব: বাল্যবিবাহকে সমাধান ভাবা, যৌতুককে স্বাভাবিক ধরা, নির্যাতিত নারীকে দোষারোপ করা—এসবই অশিক্ষা ও ভুল মূল্যবোধের প্রতিফলন।
৩. দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক চাপ: অর্থনৈতিক সংকট অনেক সময় পরিবারে উত্তেজনা বাড়ায়, যার প্রধান শিকার হয় নারী ও শিশু।
৪. আইনের দুর্বল প্রয়োগ: আইন থাকলেও কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীর শাস্তি অনিশ্চিত থেকে যায়। অপরাধ যখন শাস্তি পায় না, তখন সহিংসতা বৃদ্ধি পায়ই—কমে না।
সহিংসতার প্রভাব: ব্যক্তি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজ
১. মানসিক স্বাস্থ্যহানি: ট্রমা, উদ্বেগ, হতাশা, আত্মসম্মানহানি—নির্যাতিত নারীর মানসিক অবস্থা ভেঙে যায়। এই ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী, অনেক সময় সারাজীবন বহন করতে হয়।
২. অর্থনৈতিক ক্ষতি: নারীর উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, পরিবারে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে, কর্মজীবন বাধাগ্রস্ত হয়—ফলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
৩. প্রজন্মান্তরে সহিংসতার বীজ: যে শিশু ঘরে সহিংসতা দেখে বড় হয়, সে ভবিষ্যতে হয় সহিংস আচরণের ধারক, নইলে ভুক্তভোগী। সহিংসতার দুষ্টচক্র এভাবেই টিকে থাকে।
২৫ নভেম্বরের তাৎপর্য: বৈশ্বিক প্রতিবাদ ও আশা
২৫ নভেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নারীর প্রতি সহিংসতা কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়—এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনি ব্যবস্থা ও সামাজিক সহযোগিতা ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়।বিশ্বব্যাপী এ দিন পালন করা হয় “Orange the World” শ্লোগান নিয়ে—কমলা রঙ নতুন সূচনা, শক্তি ও আশার প্রতীক।
সহিংসতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ
১. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষাক্রমে লিঙ্গসমতা, মানবাধিকার, শ্রদ্ধাবোধ ও নৈতিকতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পরিবারেই শিশুকে শেখাতে হবে—নারী দুর্বল নয়, নারী সমান।
২. কার্যকর আইন ও শাস্তি নিশ্চিতকরণ: হটলাইন সেবা, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, আশ্রয়কেন্দ্র, আইনি সহায়তা—সবকিছু আরও বিস্তৃত ও সহজলভ্য করতে হবে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হওয়াই প্রতিরোধের প্রথম ধাপ।
৩. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: চাকরি, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, সম্পত্তির অধিকার—নারীর স্বাধীনতা যত বাড়বে, নির্যাতন তত কমবে।
৪. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : নির্যাতিত নারীর জন্য কাউন্সেলিং, থেরাপি, পুনর্বাসন ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
৫. পুরুষ ও ছেলেদের অংশগ্রহণ: পরিবর্তনের অংশীদার হতে হবে পুরুষকে। পুরুষ সমাজের আচরণ-সংস্কার পরিবর্তনে মূল ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের করণীয়: নীরবতা ভাঙার শপথ
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা
ভুক্তভোগীকে দোষারোপ না করা
সহিংসতার ঘটনা দেখলে চুপ না থাকা
অনলাইন-অফলাইনে হয়রানি দেখলে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ
পরিবারে লিঙ্গবৈষম্যমুক্ত পরিবেশ তৈরি
মানবিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সম্মানের চর্চা
পরিশেষে বলতে চাই, ২৫ নভেম্বর কেবল একটি আন্তর্জাতিক দিবস নয়—এটি মানবতার শপথ, সভ্যতার বিবেক, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা মানে শুধু নারীকে সুরক্ষিত করা নয়; এটি একটি ন্যায্য, সমতা-ভিত্তিক, উন্নত সমাজ গড়ে তোলার পথে অগ্রযাত্রা। যেদিন প্রতিটি নারী নিরাপদে হাঁটতে পারবে, কথা বলতে পারবে, স্বপ্ন দেখতে পারবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারবে—সেদিনই আমরা মানবসভ্যতার প্রকৃত গৌরব অর্জন করব।আমরা যখন নীরব শেকল ভাঙব—সেদিন নারী নয়, সহিংসতাই পরাজিত হবে।
লেখক:কলাম লেখক ও জনস্বাস্থ্য সচেতনতা সংক্রান্ত পরামর্শক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
পাঠকের মতামত:
- ‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত’
- যমুনা অভিমুখী বিসিএস পরীক্ষার্থীদের আটকে দিলো পুলিশ
- শিক্ষা ক্যাডারের আরও ২০ প্রভাষকের পদোন্নতি
- তারেক রহমানের জন্য প্রস্তুত গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়ি
- দুই সন্তানের গলা কাটা মৃতদেহের উপর মায়ের ঝুলন্ত মরদেহ
- পাবনা-৪ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে ঈশ্বরদীতে মশাল মিছিল
- সিইসি: ভালো নির্বাচনের জন্য সবার সহযোগিতা লাগবে
- তবুও আসুক পৃথিবীতে
- কাপ্তাইয়ে দীপেন দেওয়ানের নির্বাচনী প্রচারণা সভা অনুষ্ঠিত
- নড়াইলে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল ভ্যান চালকের
- শেখ হাসিনার প্লট দুর্নীতি মামলার রায় ১ ডিসেম্বর
- আন্তর্জাতিক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূল দিবস: চাই নিরাপদ, সহিংসতামুক্ত সমাজ
- গণভোট অধ্যাদেশ পাস
- 'পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোর লড়াই চলে'
- দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন খালেদা জিয়া
- দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কৃষক দলের সভাপতিকে অব্যাহতি
- গ্রাম আদালতকে আরো গতিশীল করতে চেয়ারম্যানদের নিয়ে ২ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ
- বোয়ালমারীতে পরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর
- সোনাতলায় আমন ধান কাটার ধুম পড়েছে
- গোপালগঞ্জ- ২ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর মতবিনিময়
- ঢাকায় ৩০০ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ : রাজউক চেয়ারম্যান
- নির্বাচনে কমনওয়েলথের সমর্থন চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা
- দক্ষিণ এশিয়ার সবুজ জ্বালানি রাজনীতি: কার্বন ক্রেডিট থেকে জলবায়ু ন্যায়বিচার
- নগরকান্দায় চোর সন্দেহে চার যুবককে গণপিটুনি, নিহত ১
- আদিবাসী ঢুডু সরেন হত্যাকাণ্ড, সব আসামিকে খালাস দেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ
- ‘বঙ্গবন্ধু একটি সুন্দর ও সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন’
- আজ জালালপুর গণহত্যা দিবস
- মেক্সিকোতে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৪
- ‘দ্যা এপিক ফল অব ডিক্টেটর শেখ হাসিনা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন কাল
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই বাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৩
- দুর্গাপূজা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য প্রত্যাহার দাবিতে ৪৫টি প্রবাসী বাংলাদেশি সংগঠনের যৌথ বিবৃতি
- ‘ক্ষমতা ছেড়ে দিন, এক বছরের মধ্যে পরিবর্তন করে দেবো’
- মামদানির জয়, প্রথম মুসলিম মেয়র পেলো নিউইয়র্ক
- কুমিল্লায় বাসের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ৪ যাত্রী নিহত
- বন্যা পরিস্থিতিতে এক মিনিটের জন্যও কার্যক্রম বন্ধ হবে না: সিসিক মেয়র
- ভালো বই না থাকায় এবার মধুসূদন পদক পাননি কেউ
- ইতিহাসের পাতা কি বাচ্চাদের স্লেট-পেনসিল?
- পাবনা-৪ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে ঈশ্বরদীতে মশাল মিছিল
- বিশ্ববাজারে সোনার দাম কমলো ৫ শতাংশ
- এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিতে কোনো আইনি বাধা নেই: সারজিস
- একজন নারী উদ্যোক্তার গল্প
- গাজীপুরে ৩৯ দফা দাবিতে সাংবাদিক ইউনিয়নের বিক্ষোভ
- বরগুনায় সহকারী জজের স্ত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
- ভণ্ডামি আর নাটক থেকে মুক্তি চান আঁখি আলমগীর
- মহম্মদপুরে শহীদ আবীর পাঠাগারসহ মুক্তিযোদ্ধাদের স্থাপনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি
-1.gif)








