E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার লুকানো স্থাপত্যের ভেতরের গল্প

২০২৫ নভেম্বর ২৮ ১৭:২৯:৪৩
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার লুকানো স্থাপত্যের ভেতরের গল্প

মো. ইমদাদুল হক সোহাগ


বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বাইরে থেকে দেখতে আজ অনেকটা ঝকঝকে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এক ব্যবস্থার মতো—বায়োমেট্রিক অ্যাক্সেস, মোবাইল ড্যাশবোর্ড, চকচকে শাখা, স্বচ্ছতার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ভেতরে কাজ করা মানুষদের সাথে কথা বললে—আইটি কর্মী, মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ লোকজন—একটা ভিন্ন চিত্র ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে। এই সুন্দর মুখোশের আড়ালে নাকি আরেকটি স্তর আছে—নিঃশব্দ, অস্বীকৃত, অথচ প্রভাবশালী। যেখানেই তথ্যের প্রবাহ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা গ্রাহকদের প্রতি ভিন্ন আচরণ—সব কিছুই ধীরে, আড়ালে, আরেক নিয়মে পরিচালিত হয়।

আমার নিজের অভিজ্ঞতাই যেন সেই অদেখা দুনিয়ার এক জানালা খুলে দেয়। এক সকালে দেখি, কোনো প্রকার আগাম বার্তা বা সতর্কতা ছাড়াই আমার চেকিং অ্যাকাউন্টে হঠাৎই –১.৪১ কোটি টাকা ব্যালেন্স দেখাচ্ছে। না কোনো এসএমএস, না কোনো ইমেইল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই এন্ট্রি এমনভাবে মুছে গেল যেন কখনো ছিলই না—স্মৃতি হিসেবে শুধু একটি স্ক্রিনশট রয়ে গেল। বাবার পুরোনো একটি বিষয়ের অভিযোগ জানানো মাত্রই আমার অ্যাকাউন্ট যেন ধীরে ধীরে ঢুকে গেল এক "নীরব অঞ্চলে"—যা ব্যাংকের ভেতরের লোকেরা প্রায়ই কথায় বলেন। ফোন ধরা বন্ধ, মেইলের উত্তর নেই, নিয়মিত কাজগুলিও ধীরে চলতে থাকে। তখন নিজেকে গ্রাহক কম, বরং এক অদৃশ্য প্রশাসনিক স্রোতে আটকে থাকা মানুষ বেশি মনে হয়।

ব্যাংকের ভেতরের অনেকেই একটি বিশেষ গোপন স্তরের কথা বলেন—যাকে তারা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাব বেসমেন্ট লেয়ার (এসবিএল) নামে ডাকেন। যেখানে নাকি সংবেদনশীল কাজগুলো সাধারণ নিয়ম বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। আরেকটি শব্দ শোনা যায় কন্ট্রোল রুম জিরো—যেখানে নাকি কিছু নির্দেশনা নথি ছাড়াই ঘুরে যেতে পারে। আরো কয়েকজনের কাছ থেকে পাওয়া আরেক টার্ম—স্যাডো অপারেশন ইউনিট (এসওইউ)—যে ইউনিট নাকি অভিযোগ, বিরোধ বা ‘অস্বাভাবিক’ কার্যকলাপ যুক্ত অ্যাকাউন্ট দেখাশোনা করে থাকে। এসবের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রমাণ নেই, কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন মানুষ যখন একই ধরনের বর্ণনা দেন, তখন তা গুরুত্ব পাওয়ারই কথা।

প্রযুক্তিগত লোকেরা আবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দিনের এক নির্দিষ্ট দুর্বল মুহূর্তের দিকে—রাত বারোটা থেকে ভোর পর্যন্ত এন্ড অব দ্যা ডে (ইওডি) সময়। এ সময় লগ সার্ভার অনেকসময় আংশিক রক্ষণাবেক্ষণ মোডে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই নাকি অস্থায়ী অ্যাকাউন্ট তৈরি ও মুছে ফেলা যায়। কিছু লেনদেন একাধিক স্তরের মধ্য দিয়ে ঘুরে আবার সমন্বয়ের সময় মুছে যেতে পারে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই একে বলেন—“টু এম উইমডো.” আমার অ্যাকাউন্টের টাকাটি কমার ও আবার ফিরে আসার ঘটনাও ঘটেছিল ঠিক এই সময়সীমায়। এটি যদি বিশেষ পরিস্থিতিতেই ঘটে, তবুও প্রশ্ন ওঠে—ব্যবস্থাটি কতটা শক্তিশালী ও স্বচ্ছ?

অভিজ্ঞ মানুষ আরো বলেন, ব্যাংকের প্রভাবশালী শক্তি নাকি দুই স্তরে কাজ করে—একটি দৃশ্যমান, একটি অদৃশ্য। দৃশ্যমানটিতে বড় ঋণগ্রহীতা, ডিফল্টার, মিডিয়ায় আলোচিত ঘটনা নিয়মিতই থাকে। কিন্তু অন্য স্তরটি নাকি পরিচালিত হয় অজানা ছোট প্রতিষ্ঠান, কাগুজে ব্যবসা, অদলিখিত লজিস্টিক কোম্পানির মাধ্যমে—যেগুলোর মাধ্যমে অর্থ চলাচল করে খুব নীরবে। বারবার শোনা গেছে আরেকটি নাম—ভ্যালু ২২—এক ধরনের অফলাইনে রাখা সংবেদনশীল তথ্যভাণ্ডার, যা অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা। এসব গল্প যদি পুরোপুরি সত্য না-ও হয়, তাহলেও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে একই ধরনের বিবরণ পাওয়া বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না।

আরেকটি বিষয় যেটি চিন্তার জায়গা তৈরি করে তা হলো—“জিরো কম্পিলেন মিরেজ” পরিদর্শনের সময় সিস্টেমগুলো নাকি দেখতে হয় নিখুঁত—সব লগ ঠিকঠাক, সব রেকর্ড সাজানো। অথচ আমার অ্যাকাউন্টে যে ১.৪১ কোটি টাকার যোগ-বিয়োগ ঘটেছিল, ব্যাংক থেকে দেওয়া অফিসিয়াল স্টেটমেন্টে তার কোনো উল্লেখই ছিল না—যদিও আমার স্ক্রিনশটে পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে। ডিজিটাল রেকর্ড আর বাস্তব অভিজ্ঞতার এই অমিল শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়—এটি আর্থিক সত্যের স্থিতিশীলতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।

কেনো এটি গুরুত্বপূর্ণ? কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুধু প্রযুক্তিগত এক প্ল্যাটফর্ম নয়—এটি হলো বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ানো এক চুক্তি। জনগণ টাকা জমা রাখে কারণ তারা সিস্টেমের সততা বিশ্বাস করে। বিনিয়োগকারীরা অর্থ ঢালে কারণ তারা নিয়মতান্ত্রিকতার ওপর আস্থা রাখে। অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে পূর্বানুমেয় ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু যখন ডিজিটাল রেকর্ড বদলে যেতে পারে, যখন অভিযোগ শুনতে অনীহা দেখা যায়, যখন অভ্যন্তরীণ পথঘাট অদৃশ্য থাকে—তখন সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়ে। আর বিশ্বাস ভাঙলে বিনিয়োগ কমে, প্রবৃদ্ধি থেমে যায়, সম্ভাবনা সংকুচিত হয়।

বাংলাদেশ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে অনেকটা ভালোই এগিয়েছে, কিন্তু ওপরের আধুনিকরণ যদি ভেতরের কাঠামোগত স্বচ্ছতাকে ছুঁতে না পারে, তাহলে তা যথেষ্ট নয়। এই অদৃশ্য স্থাপত্যকে সামনে এনে প্রশ্ন করার সাহস সিস্টেমকে দেখাতেই হবে। নইলে ঝকঝকে চেহারার আড়ালে দায়িত্ববোধহীন এক আর্থিক কাঠামোই টিকে থাকবে।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, ব্যাংকিং সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানাচ্ছি, এ ঘটনাগুলোকে ব্যক্তিগত অভিযোগ হিসেবে নয়, বরং গভীর কাঠামোগত ঝুঁকির ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচনা করতে। আমার আসন্ন বই দ্যা ব্ল্যাক বুক-এ নানা স্ক্রিনশট, টাইমলাইন এবং নথিভুক্ত অস্বাভাবিকতার বিশদ বিবরণ থাকবে। আমি যে অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়েছি, তা আমার বাবার সময়কার অভিজ্ঞতাকেও প্রতিধ্বনিত করে—শুধু এখন তা হয়েছে আরও পরিশীলিত ডিজিটাল রূপে।

বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এই অদৃশ্য শক্তিগুলোকে মোকাবিলা করবে, নাকি চোখ বন্ধ করে স্থিতিশীলতার ভ্রমে থাকতে চাইবে। বিশ্বাসের ভবিষ্যৎ—আর অর্থনীতির ভবিষ্যৎ—এই সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে।

লেখক : উদ্যোক্তা, ভূরাজনৈতিক বিশ্লষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৮ নভেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test