E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নির্বাচনের সুবাতাস এবং নৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন

২০২৫ ডিসেম্বর ০৯ ১৬:৫৯:৫৩
নির্বাচনের সুবাতাস এবং নৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন

মীর আব্দুল আলীম


২০২৬ এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি, আর দেশের রাজনীতি যেন একবারে উত্তাল হয়ে উঠেছে। ভোটের সময় আসলেই আমাদের মনে হতে পারে রাজনীতি আবার নতুনভাবে প্রাণ পেয়েছে, নতুন নেতার আবির্ভাব ঘটছে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। ভোটের আগে রাজনৈতিক অঙ্গন সাজানো হয় দলীয় প্রচারণার রঙে, অথচ সেখানে নৈতিকতা, সততা ও দেশের কল্যাণের চেতনা ক্রমেই বিলীন হয়। আমাদের দেশে আজ “ভালো নেতা” বলতে অনেকেই কেবল সেই নেতাকেই বোঝে যিনি দলের মুখপাত্র, যিনি মিডিয়ায় আলোচিত বা প্রচারণার মুখ। মানুষিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়ানো নেতা ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির এই ক্রমবিকাশ বোঝায় যে দেশে রাজনৈতিক সংস্কার অপরিহার্য। দল নয়, নেতৃত্বের মূলে আসুক নীতি—এটাই এখন প্রয়োজনীয়তা। প্রতিটি ভোটার, প্রতিটি নাগরিক এবং প্রতিটি রাজনীতিকের দায়িত্ব হলো সেই নৈতিক, নীতিবান মানুষকে খুঁজে বের করা, যিনি কেবল দলের স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দেবেন। নির্বাচনের সময় শুধুমাত্র দল দেখে ভোট দেয়ার মানসিকতা যদি চলতে থাকে, তবে দেশের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। তাই এই মুহূর্তে দেশের প্রত্যেক মানুষকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে—আমি কি সত্যিকারভাবে সেই নেতাকে চাইছি, যিনি দেশকে সত্যিকার অর্থে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবেন, নাকি আমি কেবল দলের নাম এবং পরিচিত মুখের পেছনে যাচ্ছি। এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়, এটি আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের এক মৌলিক সমস্যা।

দল নয়, নীতিই হউক মানুষের শক্তি ও নির্বাচন হউক নৈতিক নেতৃত্বের বিকল্প: ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কেবল একটি ভোটের প্রক্রিয়া নয়; এটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যতের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। নির্বাচনের সময় রাজনীতি নতুন করে প্রাণ পায়—রাস্তা, জনসভা, প্রচারণা, মিডিয়ার আলো সবকিছু যেন উৎসবমুখর। তবে এই সময়ের সবচেয়ে বড় সুযোগটি হলো নৈতিক ও আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্বকে সামনে আনা। ভোটাররা প্রায়শই নেতাকে কেবল বাহ্যিক চেহারা, মিডিয়ার পরিচিতি বা জনসভায় উপস্থিতি দিয়ে বিচার করে। কিন্তু দেশের স্থায়ী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নেতার অন্তর্দৃষ্টি, নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং দেশের কল্যাণে নিবেদিত মন। নৈতিক নেতৃত্ব কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেও অপরিহার্য। যিনি নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করে, তিনি সমাজে সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিক মূল্যবোধকে পুনর্জীবিত করেন। ইতিহাস প্রমাণ করে, যেসব দেশে নৈতিক নেতা নেতৃত্ব দিয়েছে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী উন্নয়ন, শান্তি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

নির্বাচনের সুবাতাস মানে কেবল উত্তেজনা নয়; এটি দেশের নৈতিক ও সামাজিক কাঠামো পুনর্গঠনের এক বিরল সুযোগ। ভোটারদের উচিত সেই নেতাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা, যিনি দলের স্বার্থ নয়, দেশের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবেন। নির্বাচনে নীতিবান মানুষকে নির্বাচিত করলে দেশ ঘুরে দাঁড়াবে, রাজনীতি ফিরে পাবে নৈতিকতা এবং সমাজে জেগে উঠবে সত্যিকারের ন্যায়পরায়ণ মূল্যবোধ। নির্বাচনের সুবাতাস কেবল উত্তেজনা নয়, এটি দেশের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের রূপায়নের এক সুযোগ। দেশের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে, নীতিবান মানুষকেই নির্বাচিত করতে হবে।

নেতাদের নৈতিকতা ও দেশের কল্যাণ: রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিকতা কেবল ব্যক্তিগত গুণ নয়, এটি দেশের ভবিষ্যতের ভিত্তি। নৈতিক ও আদর্শনিষ্ঠ নেতা দেশের জন্য চিন্তা করে, দলের স্বার্থের জন্য নয়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নৈতিকতা প্রায়শই দলীয় স্বার্থের বন্দি। অনেক নেতা নিজের স্বার্থ, ক্ষমতা ও সুবিধার জন্য কাজ করেন, জনগণের কল্যাণ নয়। সত্যিকারের নেতা নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ায়। এটি কেবল প্রচারের জন্য নয়, অন্তরের গভীরতা থেকে। যারা দেশের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়, তারা সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ধারক হয়ে ওঠে। নেতাদের নৈতিকতা দেশের উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও মানবিক সমাজের জন্য অপরিহার্য। দলের স্বার্থ নয়, দেশের কল্যাণকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। নির্বাচনের প্রাক্কালে আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টি উন্মুখ হওয়া উচিত নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের দিকে। যারা নিজেদের স্বার্থ নয়, জনগণের স্বার্থের কথা ভাবতে পারে, যারা দলীয় নির্দেশের আগে দেশের কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে জানে—তারা সত্যিকারের নেতৃত্বের যোগ্য। এই প্রয়োজনীয়তা আজও দেখা যাচ্ছে, যখন সমাজে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা এবং সুবিধাবাদী মনোভাব রাজনৈতিক মানদণ্ডকে দাপটে পরিপূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছে।

যারা নিজেদের সুবিধার জন্য কাজ করে, তাদের কণ্ঠস্বর সবচেয়ে উঁচু, কিন্তু যারা সত্যিকারের কাজ করে, তারা অনেক সময় অপ্রকাশিত এবং অদৃশ্য। তাই আমাদের উচিত সেই মানুষদের পুনরায় দৃশ্যমান করা, রাজনৈতিক পরিবেশে তাদের জন্য পথ তৈরি করা এবং ভোটারদের সচেতন করা। নির্বাচনে শুধুমাত্র দলের পরিচয় দেখলে বা জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ভোট দিলে দেশের নৈতিক ও সামাজিক কাঠামো হুমকির মুখে পড়বে। সুতরাং ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সুবাতাসে শুধু রাজনৈতিক চমক নয়, সত্যিকারের নীতিবান নেতা খুঁজে বের করাই প্রধান দায়িত্ব। এই নেতা দলীয় নয়, দেশভিত্তিক, নীতি-ভিত্তিক, আদর্শনিষ্ঠ। তিনি জনগণের দুঃখ ও কষ্টকে বুঝবেন, নৈতিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং নিজের স্বার্থকে পেছনে রেখে দেশের কল্যাণে কাজ করবেন। নির্বাচনকে শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভের খেলা বানিয়ে রাখলে দেশ কখনও এগোবে না। তাই আসুন আমরা এই সময়টিকে সদ্ব্যবহার করি, নীতিবান নেতাকে ভোট দিয়ে শক্তিশালী করি এবং দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে ন্যায় ও মানবিকতার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাই।

ভালো মানুষ কি এখনো রাজনীতিতে স্থান পায়? দেশের রাজনীতি আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে “ভালো” বা “সৎ” মানুষদের গণ্য করা যেন কঠিন হয়ে গেছে। কেবল দলের সদস্য হওয়া মানেই যে নেতা ভালো, তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানসিকতা। যদি কেউ দলের দায়িত্ব পালন না করেন বা বিরোধী দলে থাকেন, তাকে ভালো বলা যায় না। অথচ মানুষের প্রকৃত নৈতিক মূল্যায়ন এবং দেশের কল্যাণে অবদান দলীয় পরিচয়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিকার দেশভক্ত, মানবিক, ন্যায়পরায়ণ মানুষরা রাজনৈতিক চক্রের বাহিরে চলে যাওয়ায় রাষ্ট্রের মূল নৈতিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক সমাজে যখন ভালো মানুষকে দলীয় রঙে বিচার করা হয়, তখন বিবেকের স্বাধীনতা মরে যায়। আজকের রাজনীতিতে নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে কেবল বাহ্যিক প্রভাব, মিডিয়ার উপস্থিতি, সভার ভিড়, আর দলে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতার ওপর। অথচ একজন মানুষ যতই নীতিবান হোক, ত্যাগী হোক, মানবিক হোক—যদি তার দলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে, তিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিতে অদৃশ্য। এর ফলে দেশের রাজনীতিতে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং আদর্শবান মানুষরা স্থান পায় না, বরং সুবিধাবাদী এবং স্বার্থপর নেতা এগিয়ে আসে। এটি দেশের জন্য এক গভীর বিপদ।

এ অবস্থায় নির্বাচন শুধু দল পরিবর্তনের নাম নয়। এটি দেশের নৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মুহূর্ত। তাই ভোটারদের সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক। ভোটারদের উচিত সেই নেতাকে নির্বাচিত করা, যিনি দলের নির্দেশনার নয়, দেশের স্বার্থে কাজ করতে জানেন। যিনি স্বার্থপর নয়, বরং জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। নির্বাচনের এই সুযোগকে সদ্ব্যবহার না করলে, রাজনীতিতে কেবল চেহারা বদলাবে, কিন্তু দেশের ভাগ্য অচল থাকবে। সত্যিকারের নীতিবান নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে রাজনীতিকে আবার দেশপ্রেম ও নৈতিকতার দিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

শিক্ষিতরা রাজনীতিতে আসতে চায় না কেন : শিক্ষিতরা রাজনীতিতে আসতে চায় না-কারণ নীতি হারিয়ে গেছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকে। কারণ তারা দেখেছে—সততা মানে বোকামি, প্রশ্ন করা মানে বেয়াদবি, আর নৈতিকতা মানে উপেক্ষা। রাজনীতি যেহেতু আর নীতিনির্ভর নয়, তাই শিক্ষিত ও আদর্শবান তরুণেরা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এতে দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়—বুদ্ধিমত্তা আর নেতৃত্ব একসঙ্গে না থাকলে রাষ্ট্রে কেবল গৃহপালিত কর্মীবাহিনী তৈরি হয়, সত্যিকারের চিন্তাবিদ নয়। ভালো মানুষরা রাজনীতি থেকে সরে গেলে, রাজনীতিতে জায়গা করে নেয় সুবিধাবাদীরা। এবং একবার তারা আসন পেলে আর বের হয় না-বরং তারা আদর্শকে গলা টিপে মারে, যেন কেউ আর ভবিষ্যতে কথা না বলে।

রাজনীতি এখন পেশা, নৈতিকতা নয়: একসময় রাজনীতি ছিল ব্রত, ছিল জনগণের জন্য ত্যাগের পথ। কিন্তু আজ রাজনীতি হয়ে গেছে একটি পেশা। যেখানে চাকরি মেলে, জমি মেলে, নিরাপত্তা মেলে আর মেলে ‘অপারেট ইউনিট’ নামের চোরাকারবারি কাঠামো। সেবার জায়গায় এসেছে পাওনার হিসাব। ফলে ভালো মানুষ, যিনি কিছু না চেয়ে কেবল কাজ করতে চান-তিনি হয়ে ওঠেন ‘অদক্ষ’, ‘অহেলিত’, এবং অবশেষে-‘অপসারিত’। ভালো রাজনীতি করতে হলে এটিকে পেশা নয়, আবারও ব্রত বানাতে হবে। দল নয়, নীতিই হতে হবে মানুষের শক্তি। মনে রাখতে হবে ভালো মানুষদের জায়গা দিলে বদলে যাবে রাজনীতির রঙ। এই সমাজে এখনো অসংখ্য ভালো মানুষ আছে। যাঁরা চুপচাপ, প্রচারবিমুখ, কিন্তু মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। তাদের যদি রাজনীতিতে জায়গা দেওয়া হয়, তারা যদি নেতৃত্বে আসেন—তাহলে রাজনীতি থেকে দূর হবে দম্ভ, দুর্নীতি আর দলাদলি। সমাজ ফিরে পাবে সহমর্মিতা, নেতৃত্ব ফিরে পাবে বিবেক। সত্যিকারের ভালো মানুষদের দলে দলে ডেকে এনে যদি রাজনীতি সাজানো যায়, তবে এই রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াবে। দল নয়, নেতৃত্বের মূলে আসবে নীতি। গণতন্ত্রে ফিরে আসবে মানুষ এবং রাষ্ট্র হয়ে উঠবে জনতার।

শেষ কথা একটাই-রাষ্ট্র গঠনে দল নয়, দরকার আদর্শ। আদর্শবান নেতা। রাজনীতি যদি হয় কেবল ক্ষমতার সিঁড়ি, তবে ‘ভালো মানুষ’ কেবল দর্শক হয়ে যাবে, আর দল হয়ে উঠবে একচ্ছত্র দানব। তাই হচ্ছে এদেশে। আমাদের দরকার এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে নেতা নয়, নেতৃত্ব কথা বলে। যেখানে দল নয়, নৈতিকতাই হয় পরিচয়। সততা, মানবতা ও দেশপ্রেমে জেগে উঠতে হবে। দল নয়- দেশ আগে ভাবতে হবে। ভালোকে ভালো বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর সে জন্য ফেরেশতা দরকার নয়, দরকার ফেরেশতার মত একজন সৎ মানুষ, যিনি নিজের স্বার্থ নয়- দেখবেন দেশের স্বার্থ। ভালো কে? আপনি! যদি আপনি নিজেকে বদলাতে পারেন। দল নয়, নীতিই হউক মানুষের শক্তি। প্লিজ ফেব্রুয়ারীরর নির্বাচনে নৈতিক মানুষদের জায়গা দিন, এবং দেশের রাজনীতি ফিরিয়ে আনুন জনগণের হাতে। শুধু তখনই রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াবে। শুধু তখনই রাজনীতি সত্যিকারের দেশপ্রেমে জেগে উঠবে। শুধু তখনই জনগণ ফিরে পাবে ক্ষমতা, ন্যায় এবং আশা।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৯ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test