E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

২০২৫ ডিসেম্বর ১৫ ১৬:৫৩:১২
বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ড. মাহরুফ চৌধুরী


বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের মূলভিত্তি। ইতিহাসবিদ বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (১৯৩৬-২০১৫) তাঁর ‘কল্পিত সমাজ’ (ইমাজিন্ড কমিউনিটিজ) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, একটি জাতি কেবল ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে নয়, বরং নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের কল্পনা ও সংজ্ঞায়িত করে। সেই অর্থে বাংলাদেশের জাতিসত্তা কোনো আকস্মিক নির্মাণ নয়; এটি দীর্ঘ সময়জুড়ে গড়ে ওঠা এক যৌথ কল্পনা ও ঐতিহাসিক চেতনার ফসল। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম (১৯৬২), ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬), ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) এসব ঘটনার ধারাবাহিক প্রতিরোধ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস আমাদের জাতীয় সত্তাকে ধাপে ধাপে সুদৃঢ় করেছে। এই সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই; একই সঙ্গে বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের সংগ্রাম। ভাষা, সংস্কৃতি ও সম্মানের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানই এই আন্দোলনগুলোকে সাধারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে পৃথক করেছে এবং একে জাতি-নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রকল্পে রূপ দিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু একটি যুদ্ধ নয়; এটি ছিল রাষ্ট্র, নাগরিকত্ব ও সম্মিলিত ভবিষ্যৎ কল্পনার পুনর্গঠন।

এই প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবস কোনো আনুষ্ঠানিক স্মরণ উৎসব মাত্র নয়, কিংবা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের কৃতিত্ব বন্দনার দিনও নয়। বরং এটি বাংলাদেশি হিসেবে জাতির আত্ম-সন্ধান ও আত্ম-নির্মাণের দীর্ঘ দার্শনিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পথচলার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিজয় দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতি হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। অতীতের সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের দায়িত্ব গ্রহণ এবং ভবিষ্যতের রূপকল্প নির্মাণই এর প্রকৃত তাৎপর্য। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তাই একটি মৌলিক ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন সামনে আসে: বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের হয়ে উঠতে পেরেছে? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, রাষ্ট্র কি সেই লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়েছে? ইতিহাসবিদ এ. এফ. সালাউদ্দিন আহমদ (১৯২০ - ২০১৪) উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, উপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর খুব দ্রুতই একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক অভিজাত (পোস্ট-কলোনিয়াল এলিট) শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা জনগণের মুক্তির ভাষ্য ব্যবহার করলেও বাস্তবে ক্ষমতা ও সম্পদের নতুন কেন্দ্র তৈরি করে। ফলে শাসকের চরিত্র বদলায়, কিন্তু শাসিতের জীবনে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অনুপস্থিতই থেকে যায়।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও এ বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়। এখানেও নব্য অভিজাত শ্রেণির হাতে ব্যক্তি, পরিবার ও দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে স্বাধীনতার বয়ান বারবার পুনর্লিখিত ও বিকৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, যা ছিল আপমর জনগণের সামষ্টিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, ক্রমে একটি বিশেষ গোষ্ঠির হাতে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে প্রতীকী পুঁজির রূপ নেয় যার মাধ্যমে ক্ষমতার বৈধতা দাবি করা হয়, কিন্তু জবাবদিহিতা দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে ইতিহাস নিজেই তর্ক-বিতর্ক ও বিভাজনের উপাদানে পরিণত হয়, আর রাষ্ট্র ধীরে ধীরে গণমানুষের বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে গভীর পরিণতি হলো যুদ্ধের অর্জন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অর্থবহভাবে কখনোই প্রতিফলিত না হওয়া। যে মুক্তি জাতিকে শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসানের কথা বলেছিল, তা রাষ্ট্রীয় নীতিতে ও সামাজিক বাস্তবতায় পূর্ণতা পায়নি। ফলে স্বাধীনতা একটি জীবিত অভিজ্ঞতা না হয়ে ক্রমে স্মৃতিনির্ভর বয়ানে আবদ্ধ হয়ে পড়ে যা বছরের পর বছর ধরে বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করলেও শাসক শ্রেণিকে বিজয়ের দায়বদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাস কোনো স্থবির সত্তা নয়; তা তার নিজস্ব গতিতেই অগ্রসর হয়। আর সংগ্রামী জনগণের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও স্বনির্ভর হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও কখনো বাতাসে মিলিয়ে যায় না। বিপ্লব ও মুক্তিচিন্তার তাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ ফ্যানন (১৯২৫–১৯৬১) তাঁর লেখায় স্পষ্ট করে বলেছেন, জনগণের অসমাপ্ত মুক্তির দায়ভার প্রতিটি যুগে নতুন প্রজন্মের কাঁধেই এসে পড়ে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের ভুল, সীমাবদ্ধতা ও বিচ্যুতি সংশোধনের মধ্য দিয়েই ইতিহাস এগিয়ে যায়, এবং সেই প্রক্রিয়ায় তরুণেরা কেবল উত্তরাধিকারী নয়, বরং সক্রিয় নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তরুণদের এই ভূমিকা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাকশালী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, এমনকি ২০১৮ সালের রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান প্রতিটি পর্বেই দেশের তরুণেরা গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের দাবিতে অগ্রভাগে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় দমন, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও আত্মত্যাগের ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা বারবার দেখিয়েছে যে ইতিহাসের সংকটময় মুহূর্তে নীরবতা নয়, প্রতিরোধই তাদের রাজনৈতিক ভাষা। এই ধারাবাহিক সংগ্রাম আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য উন্মোচন করে। তরুণদের রাজনৈতিক চেতনা ব্যক্তিপূজা বা ক্ষমতার আনুগত্যে আবদ্ধ নয়; বরং তা ন্যায়, স্বাধীনতা ও মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের আদর্শে প্রোথিত। তাদের আন্দোলন স্মরণ করিয়ে দেয়, বিজয় কেবল অতীতের স্মৃতিতে বন্দি কোনো ঘটনা নয়; এটি একটি চলমান নৈতিক দায়, যা প্রতিটি প্রজন্মকে নতুন করে ধারণ ও বহন করতে হয়।

কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের কুটকৌশলের কারণে ইতিহাসের নামে বিভেদ সৃষ্টির রাজনীতি আজও সক্রিয় রয়েছে। দার্শনিক মাইকেল ফুকো (১৯২৬–১৯৮৪) ক্ষমতা ও জ্ঞানের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, ক্ষমতা কখনো নিরপেক্ষ থাকে না; বরং সে ইতিহাসকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী পুনর্লিখন করতে চায়। এই প্রক্রিয়াকেই তিনি ‘ইতিহাসের রাজনৈতিক বয়ান’ (পলিটিক্স অব হিস্টোরিক্যাল ন্যারেশান) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যখন ইতিহাস ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তখন তা নাগরিকদের স্মৃতিকে বিভক্ত করে এবং রাষ্ট্রকে একটি সামষ্টিক গণতান্ত্রিক প্রকল্প হিসেবে বিকশিত হতে বাধা দেয়। তাই আজও যারা ইতিহাসকে দলীয়করণ করে নাগরিকদের মধ্যে কৃত্রিম বিভাজন সৃষ্টি করে, তারা কার্যত রাষ্ট্রকে জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখার এক সূক্ষ্ম কৌশল প্রয়োগ করে। এরা ইতিহাসকে মুক্তির প্রেরণা হিসেবে নয়, বরং ক্ষমতা ধরে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যার ফলে গণতন্ত্র রূপ নেয় সীমিত অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতায়, আর রাষ্ট্র ক্রমে জনমানুষের নৈতিক দাবি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে সময়ের পরিক্রমায় আত্মউপলব্ধির মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম এই কুটকৌশলগুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। তারা অতীতকে আর বিবাদ ও প্রতিহিংসার উপাদান হিসেবে নয়, বরং শিক্ষা, দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করছে। এই প্রজন্ম নতুন করে ‘দেশ ও দশের কল্যাণে’ নিজস্ব ‘দায় ও দরদের ভিত্তিতে’ একটি ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ ও ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র বিনির্মাণে অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে।

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বর্তমান বাস্তবতায় যারা ইতিহাসকে ঘৃণা ও বিভেদের হাতিয়ার বানায়, তারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক। তারুণ্যের সংঘবদ্ধ চেতনা ও নৈতিক শক্তির উন্মোচনের মুখে এসব শক্তি আজ ক্রমেই ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। তরুণদের জন্য এখনই সেই সময় এই দুর্বৃত্তায়িত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকে সচেতনতা, সংগঠিত উদ্যোগ ও নৈতিক দৃঢ়তার মাধ্যমে মোকাবিলা করে ইতিহাসকে তার প্রকৃত মুক্তির অবারিত ধারায় ফিরিয়ে আনার। আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীত আমাদের পরিচয়ের বাহক হলেও ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় বর্তমানের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে। রাজনৈতিক দার্শনিক হেগেল (১৭৭০–১৮৩১) ইতিহাসকে কেবল অতীত ঘটনাপুঞ্জের ধারাবিবরণী হিসেবে দেখেননি; তিনি একে মানবমুক্তির ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ইতিহাস আমাদের বলে দেয় শুধু কী ঘটেছে তা নয়, বরং কোন সম্ভাবনার দিকে মানবসমাজ অগ্রসর হতে পারে সে দিকনির্দেশনাও দেয়। অর্থাৎ ইতিহাস তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠে, যখন তা ভবিষ্যৎ নির্মাণের বোধ ও নৈতিক দায়িত্বকে জাগ্রত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেতনা কেবল অতীতের গৌরবগাথা নয়; এটি আমাদের বর্তমান কর্তব্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নৈতিক ভিত্তি।

মুক্তিযুদ্ধ যে কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা ছিল মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, জনগণের অংশগ্রহণে পরিচালিত এবং বৈষম্যহীন এক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায় আজ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মকেই বহন করতে হবে। অতএব আজকের বাংলাদেশে বিজয় দিবস উদযাপনের প্রকৃত অর্থ হবে মানবিক রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সংকল্প গ্রহণ করা এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণকে ইতিহাসচেতনার নতুন স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এই চেতনা বিজয়কে অতীতের স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে ভবিষ্যৎ নির্মাণের সক্রিয় নৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারবে। আর বিজয় দিবস হয়ে ওঠবে চিন্তার, দায়িত্বের ও সমষ্টিগত অগ্রযাত্রার অঙ্গীকারের দিন। সমকালীন বিশ্বে যে সংকীর্ণ ও বর্জনমূলক জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার বিপরীতে আমাদের প্রয়োজন ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ (সিভিক ন্যাশানালিজম) নামে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তা। এই ধারণায় রাষ্ট্র ও জাতির ভিত্তি নির্ধারিত হয় রক্ত, ধর্ম বা নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়ে নয়; বরং নাগরিকত্ব, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক দায়দায়িত্বের যৌথ চুক্তির মাধ্যমে। আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বে এটাই সেই পথ, যেখানে ভিন্নতা রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়, বরং তার শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’, ন্যায়ের শাসন, ভাষার প্রতি সম্মান, এবং ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রদর্শন কোনো অলংকারমূলক শব্দাবলি নয়; বরং একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক শর্ত।

ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে, যে রাষ্ট্রে শাসক শ্রেণি ভিন্নমতকে শত্রুতে পরিণত করে, সে রাষ্ট্রযন্ত্র শেষ পর্যন্ত নাগরিকের আস্থা হারায় এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের ভিতকে দুর্বল করে তোলে। বিপরীতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও পারস্পরিক সম্মান যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, সেখানেই রাষ্ট্র নাগরিকের হয়ে ওঠে। আমরা যে ‘দায় ও দরদ’-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, তা কোনো আবেগী শ্লোগান নয়; এটি একটি সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে তখনই, যখন এ প্রজন্মের নবীন নেতৃত্ব সংকীর্ণ ক্ষমতাচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে সুদূরপ্রসারি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি, নৈতিক দৃঢ়তা ও কার্যকর কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে নতুন করে কল্পনা ও নির্মাণে এগিয়ে আসবে। সেখানেই বিজয় দিবস অতীতের স্মরণ থেকে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনায় রূপ নেবে। আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে বিজয় দিবস কেবল অতীতের স্মৃতি রোমান্থনের দিন নয়; এটি ভবিষ্যতের নির্দেশনা নির্ধারণ এবং আগামীর স্বপ্নকল্পকে বাস্তব রূপ দেওয়ার নতুন পদক্ষেপ গ্রহণে প্রেরণার উৎস। বিজয়ের স্মরণ তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা আমাদের বর্তমানকে প্রশ্ন করে এবং ভবিষ্যতের দায় স্মরণ করিয়ে দেয়। এই অর্থে বিজয় দিবস আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতা শুধু একটি রাষ্ট্র অর্জনের ঘটনা নয়; স্বাধীনতা হলো মানুষের মর্যাদা, সমতা ও মানবিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অবিরাম ও সচেতন সংগ্রাম।

নতুন প্রজন্ম ক্রমেই উপলব্ধি করছে দেশপ্রেম মানে কেবল অতীতের গৌরবগাথা উচ্চারণ নয়, কিংবা আনুষ্ঠানিক দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নয়। প্রকৃত দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে বর্তমানকে মানবিক করার প্রচেষ্টায় এবং ভবিষ্যৎকে ন্যায়ভিত্তিক ও জনকল্যাণমুখী করে গড়ে তোলার সংকল্পে কর্মপ্রচেষ্টায়। এই বোধই তরুণ প্রজন্মকে স্মৃতি-নির্ভর আবেগ থেকে দায়িত্ব-নির্ভর রাজনৈতিক চেতনার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। ইতিহাস আমাদের কাছে শুধু বর্ণনা নয়; এটি এক গভীর রক্তঋণ। পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্র ও নাগরিকত্ব আমাদের কেবল অধিকার দেয় না, বরং আরোপ করে এক গুরুদায়িত্ব। আর সেটা হলো এই রাষ্ট্রকে ন্যায়, মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোয় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই বিজয় দিবস স্মৃতির দিন থেকে রূপ নেয় কর্মের ও প্রতিজ্ঞার দিনে। ইতিহাসের পালাবদলে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা আর কোনো এক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের একচেটিয়া দখলে থাকবে না। রাজনৈতিক বক্তব্যে কেউ নিজের একক কৃতিত্বকে প্রাধান্য দিতে পারবে না, কারণ এই দেশ সকলের, ইতিহাস সকলের, আর স্বাধীনতার প্রকৃত মালিক হলো দেশের জনগণ। যারা ইতিহাসকে বিভেদ ও শত্রুতার হাতিয়ার বানায়, তারা বাস্তবে ইতিহাসের শত্রু। বিপরীতে, যারা দায়িত্ব পালন করে, বর্তমানকে মানবিক করে এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, ইতিহাস তাদেরই স্মরণ করে তাদের কৃতিত্ব সর্বজনীন ও চিরস্থায়ী হয়।

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর গণআকাঙ্ক্ষা পূরণে আমাদের সকলকে দল, মত ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে একটি স্বৈরাচারমুক্ত, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলায়। এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার স্থায়ীভাবে নিরাপদ থাকবে। নতুন প্রজন্মের শক্তি, অধ্যবসায় এবং বুদ্ধিবৃত্তি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। বিজয় দিবস আজ সেই পথ নির্দেশ করে অতীতের সংগ্রামকে স্মরণ করিয়ে দেয়, বর্তমানের দায়বদ্ধতা জাগ্রত করে এবং ভবিষ্যতের ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণে প্রেরণা যোগায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের পর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো স্বাধীনতার অর্থ কেবল সনদে সীমাবদ্ধ না রেখে, সেটিকে মানুষের জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় প্রতিফলিত করা। এখানেই বিজয় দিবসের প্রাসঙ্গিকতা, শক্তি ও শিক্ষার মূল তাৎপর্য নিহিত। তাই বিজয় দিবস আমাদের কাছে কেবল একটি ঐতিহাসিক তারিখ বা দিন নয়; এটি জাতীয় জীবনের একটি চলমান নৈতিক অঙ্গীকার। এই দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা কোনো স্থির অর্জন নয়; এটি একটি সচেতন প্রক্রিয়া, যা প্রতিদিন নতুন করে রক্ষা ও বিকশিত করতে হয়।

অতীতের আত্মত্যাগ আমাদের পরিচয় নির্মাণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই পরিচয়কে অর্থবহ করে তোলে বর্তমানের দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যতের দূরদর্শী পরিকল্পনা। বিজয়ের প্রকৃত তাৎপর্য তখনই প্রকাশ পায়, যখন রাষ্ট্র নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় আর স্বাধীনতা লাভের ইতিহাস বিভেদের নয়, প্রকৃতপক্ষে ঐক্যের শক্তিতে রূপ নেয়। নতুন প্রজন্ম আজ যে প্রশ্নগুলো তুলছে, যে স্বপ্নগুলো লালন করছে, সেখানেই বিজয় দিবসের সবচেয়ে জীবন্ত অর্থ নিহিত। তারা বুঝেছে দেশপ্রেম মানে স্মৃতির বন্দনায় আটকে থাকা নয়; দেশপ্রেম মানে সামষ্টিক কল্যাণে ন্যায়, মানবিকতা ও গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় রূপ দেওয়া। এই প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, নৈতিক দৃঢ়তা ও কর্মপ্রচেষ্টাই পারে স্বাধীনতার রক্তঋণ শোধ করতে এবং বাংলাদেশকে একটি স্বৈরাচারমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। অতএব বিজয় দিবস আমাদের জন্য কোনো সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন সূচনা। এই দিন আমাদের আহ্বান জানায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে রূপান্তর করতে, এবং ভবিষ্যৎকে ন্যায়ভিত্তিক ও জনকল্যাণমুখী করে গড়ে তুলতে। বিজয়ের সত্যিকার সম্মান তখনই রক্ষা পাবে, যখন স্বাধীনতার অর্থ মানুষের জীবনে, রাষ্ট্রের কাঠামোয় এবং জাতির সামষ্টিক চেতনায় পূর্ণতা লাভ করবে।

লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।

পাঠকের মতামত:

১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test