E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সীমান্ত পেরিয়ে মানুষের মর্যাদা ও মানবিক অধিকার

২০২৫ ডিসেম্বর ১৮ ১৭:৪৭:৪২
সীমান্ত পেরিয়ে মানুষের মর্যাদা ও মানবিক অধিকার

ওয়াজেদুর রহমান কনক


মানুষের চলাচল মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই টিকে থাকার, উন্নতির এবং অভিযোজনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় এই চলাচল আর নিছক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ নেই; এটি অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক বৈষম্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজ জীবিকা, নিরাপত্তা, মর্যাদা কিংবা বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষার তাগিদে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে বা অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই বাস্তবতা মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।

এই উপলক্ষ্যের মূল উদ্দেশ্য হলো চলাচলরত মানুষদের কেবল শ্রমশক্তি বা পরিসংখ্যান হিসেবে নয়, বরং পূর্ণ মানবসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। যারা সীমান্ত অতিক্রম করে নতুন জীবনের সন্ধানে যায়, তারা অর্থনীতি সচল রাখে, সংস্কৃতির বিনিময় ঘটায় এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে—তবু তাদের বড় একটি অংশ শোষণ, বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা ও আইনি অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করে। তাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে তাদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়টি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিসরে দৃশ্যমান করা।

একই সঙ্গে এই সচেতনতার লক্ষ্য হলো রাষ্ট্র ও সমাজকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে উন্নয়ন কেবল পুঁজি ও প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না; মানুষের নিরাপদ চলাচল, ন্যায্য কাজের সুযোগ এবং মানবিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাও উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও জলবায়ু সংকটে বাধ্যতামূলকভাবে স্থানান্তরিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক নীতিমালা ও কার্যকর আন্তর্জাতিক সহযোগিতাই এই উদ্যোগের কেন্দ্রীয় দর্শন।

দিবসটির উদ্দেশ্য হলো বৈশ্বিক সংহতি জোরদার করা—যাতে সীমান্ত মানুষের মর্যাদার দেয়াল হয়ে না দাঁড়ায়। চলাচলরত মানুষের জীবনসংগ্রামকে বোঝা, তাদের অবদানকে সম্মান করা এবং নিরাপদ, নিয়মিত ও মানবিক চলাচলের পরিবেশ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বব্যবস্থার পথ প্রশস্ত হয়।

নির্বাচিত ও যাচাইযোগ্য আন্তর্জাতিক সূত্রের আলোকে অভিবাসন (migration) বিষয়ে পিএইচডি-সমমানের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করলে প্রথমেই স্পষ্ট হয় যে অভিবাসন একটি একমাত্রিক ঘটনা নয়; বরং এটি জনসংখ্যাগত রূপান্তর, বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, মানবাধিকার ও পরিবেশগত সংকটের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফল। আন্তর্জাতিক অভিবাসন অধ্যয়নের ক্ষেত্রে জনসংখ্যাগত পরিমাপ যেমন আন্তর্জাতিক অভিবাসীর মোট সংখ্যা ও প্রবাহ, জোরপূর্বক স্থানান্তর ও শরণার্থী বাস্তবতা, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি, রেমিট্যান্সভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবাহ, জলবায়ু-প্ররিত অভিবাসন এবং নীতিগত ও আইনি কাঠামো—এই সবগুলো মাত্রাকে একসঙ্গে বিবেচনায় নিতে হয়। একই সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে সংজ্ঞাগত ভিন্নতা, ডেটা-গ্যাপ ও পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা অভিবাসন গবেষণার একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা বিভাগ (UN DESA)-এর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী ২০২৪ সালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক অভিবাসীর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৩০৪ মিলিয়নে, অর্থাৎ এমন মানুষ যারা নিজ জন্মভূমির বাইরে অন্য দেশে বসবাস করছে। এই সংখ্যা ২০২০ সালের প্রায় ২৭৫ মিলিয়নের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে এবং এটি প্রমাণ করে যে বিশ্বায়ন, শ্রমবাজারের চাহিদা, সংঘাত ও পরিবেশগত চাপ মিলিয়ে মানুষের চলাচল ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। আঞ্চলিকভাবে এই অভিবাসীদের বড় অংশ ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কেন্দ্রীভূত, এরপর রয়েছে পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকা। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM)-এর World Migration Report 2024 দেখায় যে উন্নত অর্থনীতিগুলো অভিবাসী শ্রমের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল হলেও সেই শ্রমশক্তির সামাজিক ও আইনি সুরক্ষা প্রায়ই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

অভিবাসনের সবচেয়ে সংকটপূর্ণ দিকটি প্রকাশ পায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের পরিসংখ্যানে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (UNHCR)-এর Global Trends রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে আনুমানিক ১২৩.২ মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত অবস্থায় ছিল, যার মধ্যে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত। এই সংখ্যা বিগত এক দশকের তুলনায় সর্বোচ্চ এবং এটি নির্দেশ করে যে যুদ্ধ, দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পরিবেশগত দুর্যোগ মানবজীবনের নিরাপত্তাকে গভীরভাবে বিপর্যস্ত করছে। একই রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪২.৭ মিলিয়ন, যা আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো ও মানবিক সহায়তা ব্যবস্থার ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করছে।

অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি অভিবাসন সংকটের আরেকটি বড় মাত্রা, যা প্রায়ই আন্তর্জাতিক আলোচনায় তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পায়। Internal Displacement Monitoring Centre (IDMC)-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বে প্রায় ৪৬.৯ মিলিয়ন নতুন অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে, যার অধিকাংশই প্রাকৃতিক দুর্যোগ—বিশেষ করে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও ভূমিকম্প—জনিত। এই প্রবণতা স্পষ্ট করে যে জলবায়ু পরিবর্তন কেবল ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়; এটি ইতোমধ্যেই মানুষের বসবাস ও জীবিকাকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অভিবাসনের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রভাব হলো রেমিট্যান্স প্রবাহ। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী ২০২৪ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে (LMICs) রেমিট্যান্সের পরিমাণ আনুমানিক ৬৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে, যা একটি রেকর্ডকৃত উচ্চতা। এই রেমিট্যান্স প্রবাহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দারিদ্র্য হ্রাস এবং গৃহস্থালির ভোগব্যয় টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে অভিবাসীরা গৃহসেবা, স্বাস্থ্যখাত, নির্মাণ, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের মতো শ্রমঘন খাতে অপরিহার্য অবদান রাখলেও তাদের মজুরি, কর্মনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা প্রায়ই অনিশ্চিত থেকে যায়—যা বৈশ্বিক শ্রমবাজারের একটি কাঠামোগত বৈষম্যকে নির্দেশ করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অভিবাসন ও রেমিট্যান্স একটি কৌশলগত অর্থনৈতিক বাস্তবতা। বিশ্বব্যাংকের ‘Personal remittances, received’ সূচক অনুযায়ী ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি জাতীয় আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সামাজিক গতিশীলতায় বড় ভূমিকা রাখলেও প্রবাসে শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মানজনক কর্মপরিবেশ এখনো বড় নীতিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।

ভবিষ্যতের দিকে তাকালে জলবায়ু পরিবর্তন অভিবাসনের মাত্রাকে আরও গভীর করবে বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। IPCC-এর ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদন (AR6) দেখায় যে উপকূলীয় অঞ্চল, বন্যাপ্রবণ নিম্নভূমি ও খরাপীড়িত কৃষিভিত্তিক এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী ক্রমেই স্থানান্তরে বাধ্য হবে। তবে ‘জলবায়ু শরণার্থী’ ধারণাটি আন্তর্জাতিক আইনে এখনো সুস্পষ্ট স্বীকৃতি পায়নি, ফলে এই জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুতর আইনি শূন্যতা রয়ে গেছে।

অভিবাসন গবেষণার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতাগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় ‘মাইগ্র্যান্ট’, ‘শরণার্থী’ ও ‘অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত’ শব্দগুলোর সংজ্ঞাগত ভিন্নতা রয়েছে, আবার অননথিভুক্ত বা আধা-নথিভুক্ত অভিবাসনের প্রকৃত পরিসংখ্যান সংগ্রহ করাও কঠিন। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি প্রায়ই ব্যাখ্যাত সংখ্যার চেয়েও বিস্তৃত হয়। এই কারণে পিএইচডি-স্তরের গবেষণায় কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং কেস-স্টাডি ও গুণগত বিশ্লেষণ যুক্ত করা অপরিহার্য।

গত কয়েক দশকে অভিবাসন একটি স্থায়ী বৈশ্বিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে—সংখ্যাগত দিক থেকে যেমন আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা ৩০৪ মিলিয়নে পৌঁছেছে, তেমনি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১২৩ মিলিয়নের গণ্ডি অতিক্রম করেছে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সের মতো অর্থনৈতিক প্রবাহ বৈশ্বিক উন্নয়ন কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। তবে তথ্যগত গ্যাপ, সংজ্ঞাগত অস্পষ্টতা এবং আইনি-নীতিগত অসামঞ্জস্য এই ক্ষেত্রকে আরও গভীর গবেষণার দাবি জানাচ্ছে। এই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে তাত্ত্বিক নির্মাণ, তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও নীতিনির্ধারণে প্রাসঙ্গিক সুপারিশ প্রদানই অভিবাসন বিষয়ে গবেষণার প্রধান দায়িত্ব।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১৮ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test