E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

একজন ভক্ত সাহা’র কথা 

২০২৫ ডিসেম্বর ১৮ ১৮:২১:৫৩
একজন ভক্ত সাহা’র কথা 

শিতাংশু গুহ


ভক্ত গোপাল সাহা (বিজিসাহা) আমার আপন মায়ের পেটের ভাই নন, কিন্তু নজরুলের ভাষায় ‘আপনার চেয়ে আমার আপন যে জন–’ অর্থাৎ ভাইয়ের চেয়েও আপন যে ভাই, তিনি আজ ঢাকায় মারা গেছেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি, শোক-সন্তপ্ত পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা। বয়স হয়েছিলো, তাই দু:খ নেই, তবে বেদনা আছে। শুধু আমি নই, তার সংস্পর্শে যাঁরা গেছেন, সবাই মর্মাহত হবেন। তার বড় ছেলে রাকেশ পলাশ সাহা জানালো, বিজিসাহা’র ড্রাইভার ‘রাসেল’ এই ক’দিন হাসপাতালে পড়েছিল। বিজিসাহা ছেলেকে বলে গেছেন, রাসেল তোমার সহোদর না হলেও তোমার ভাই, ওঁকে দেখো। রাকেশ জানালো, রাসেল শুধু ড্রাইভার ছিলোনা, ঘরের বাইরে সে-ই ভক্ত সাহাকে দেখতো। 

বিজিসাহা সচল ছিলেন, সদ্য তিনি কলকাতা থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ঢাকায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন, হাসপাতালে ভর্তি হন, সম্ভবত: কিডনি অচল হয়ে মৃত্যু’র কোলে ঢলে পড়েন। বাবার অসুস্থতার সংবাদে রাকেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে আগেই ঢাকা আসে। ছোটভাই রাতুল অষ্ট্রিয়া থেকে মঙ্গলবার দেশে আসছে। আমার নিজেরও যেতে ইচ্ছে করছে, অফিস ছুটি, তবু ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’। বিজিসাহা আমার মেজদা প্রেমাংশু’র বন্ধু। তার চরিত্রের কতটা ‘ম্যাজিক’ থাকলে বিজিসাহা পুরো গুহ ফ্যামিলি’র সদস্য হয়ে যান, তা যারা তার সাথে মিশেছেন তারাই ভাল বুঝবেন। পেশায় তিনি ছিলেন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ‘নল’ নামে একটি বিদেশী কোম্পানীতে কাজ করতেন। পরে ‘মেডিমপেক্সের’ কর্ণধার হ’ন, দীর্ঘদিন তাই ছিলেন।

তিনি ছিলেন এলএমএফ ডাক্তার। পুরান ঢাকার হয়তো সকল বয়স্ক লোকই তার রুগী ছিলেন। এমন ডাক্তার কোথায় পাবেন, যিনি বিনে-ভিজিটে বাড়ী বাড়ী গিয়ে চিকিৎসা করতেন, প্রায়শ: ওষুধ কিনে দিতেন। অনেকের বাড়ীর বাজারও তিনি করে দিতেন। পুরান ঢাকায় মেজদা’র বাসায় মা’র ডাক্তারী তিনি করতেন, বাবা ঢাকা গেলে তিনি ডাক্তার, বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন, এমনকি মাঝে-মধ্যে বাজারও করে দিতেন। মা বিজিসাহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। আমি জানি বিজিসাহা এমনি করে পুরান ঢাকার হিন্দু-মুসলিম বহু পরিবারের সন্তান হয়ে গিয়েছিলেন। তার পত্নী রিতা সাহা বায়োকেমিস্ট্রীতে ঢাকা ভার্সিটি’র এমএসসি, কিন্তু অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, স্বামীর এসব ‘পাগলামী’ তিনি মেনে নিয়েছিলেন।

আগে আমাদের দেশে অনেকে বাপের জমিজমা বিক্রী করে রাজনীতি করতেন, অনেকে শুধুমাত্র সেবার খাতিরে ডাক্তারী করতেন, বিজিসাহা হয়তো তাদেরই একজন। তাঁর পরিবার ধনাঢ্য ছিলো বলা যায়, কলাকোপা-বান্দুরায় তাঁদের অনেক সম্পত্তি ছিলো, সেগুলো কি হয়েছে আমার জানা নেই। তবে স্থানীয় মুসলমান তা দখল করে নিচ্ছিলো তা জেনেছি। এনিয়ে তার কোন অভিযোগ শুনিনি। রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও তিনি সচেতন ছিলেন, এবং ঢাকা থাকতে আমায় বহুবার সতর্ক করেছেন। চাকুরিটি তিনি যথেষ্ট ভাল করতেন, ডাক্তারদের সাথে সু-সম্পর্ক ছিলো। বড়লোক না হলেও পয়সার অভাব তার ছিলোনা, তাই মানুষকে সাহায্য করতে কখনো পিছপা হ’ননি।

তাকে আমি শেষবার দেখেছি ২০১৭ না ২০১৪ তা আমার মনে নেই। তার বাসায় গিয়েছিলাম, অনেকদিন বাদে বৌদি’র হাতের রান্না খেয়েছিলাম। এরপর মাঝেমধ্যে কথা হতো, তবে সকল খবর পেতাম আমার গিন্নীর থেকে, তিনি মেজবৌদি’র কাছ থেকে জেনে নিতেন। মেজদা ও বিজিসাহা’র পরিবারের সাথে সর্বদা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো, এখনো আছে। মেজদা’র কাছ থেকে আমি প্রথমে খবরটি জানতে পারি, প্রায় একই সাথে ফেইসবুকে রাকেশের পোস্টিং দেখি, ‘আমাদের বাবা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন’। ভাবতে অবাক লাগে, এহেন একজন সাদাসিদে ভদ্রলোককে ডিবি পুলিশ মাঝে-মধ্যে ডিস্টার্ব করতো, এমনকি আওয়ামী লীগ আমলেও করেছে। তেমন কিছু নয়, একজন হিন্দু ভদ্রলোক-কে ডিস্টার্ব করা আরকি!

ইতিহাসে আমরা অনেক মাতৃভক্ত সন্তানের কথা জানি। বিজিসাহা তার ‘বেড-রিডেন’ মা-কে যেভাবে সেবা করেছেন তা আমি মাঝে-মধ্যে দেখেছি। এটি সম্ভবত: বিজিসাহা’র দ্বারাই সম্ভব। স্ত্রী রিতা সাহাকে এজন্যে ধন্যবাদ দেয়াই যায়। তিনিও ঢাকা থাকতেন, আমিও ঢাকা থাকতাম, কালেভদ্রে আমাকে তার কাছে যেতেই হতো। আমার স্ত্রী আলপনা বিয়ের আগেই তার ভক্ত, কারণ আমাদের বিয়েটা তিনিই সম্ভব করেছিলেন। তিনি আমেরিকা এসেছিলেন, আল্পনা তার সেবাযত্ন করতে চাইলে বরং তিনিই আমাদের সেবা দিয়ে কৃতার্থ করে গেছেন। আমি কঠিন অসুস্থ হলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনিই আমায় ডাঃ বদরুদ্দোজার কাছে নিয়ে যান। এমন মানুষ কারো সেবা নিতে অভ্যস্থ নন, তিনি সেবা দিয়েই গেছেন।

রাকেশ জানালো, ওঁরা বিজিসাহাকে নিয়ে একটি স্মৃতিসভার আয়োজন করতে চাচ্ছে। আমি জানি সেখানে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জানাবেন কিভাবে তারা উপকৃত হয়েছিলেন। এ নাছোড়বান্দা উপকারী, উপকার নিতে না চাইলেও তিনি উপকার করবেন এবং কোনো প্রত্যুৎপকারের সুযোগই দেবেন না? তার সান্নিধ্যে এসে আমি ধন্য। তার বয়স কত হয়েছিলো, ৮৫? আমি ঠিক জানিনা। তবে কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় সকলের দোয়া-আশীর্বাদে তিনি বিছানায় পরে রোগ-শোকে ভুগেননি। বিজিসাহা নাই, কি আর করা, তিনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন। রাকেশকে বলেছি যে, তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করে কি করা যায় সেই সিদ্ধান্ত নিও। ভক্ত সাহাকে আমার শেষ প্রণাম। “ওঁ দিব্যান লোকান স-গচ্ছতু”।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

১৯ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test