E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

প্রতিহিংসামুক্ত আগামীর স্বপ্ন ও রাজনীতির নবদিগন্ত

২০২৫ ডিসেম্বর ২৬ ১৭:৪৫:০০
প্রতিহিংসামুক্ত আগামীর স্বপ্ন ও রাজনীতির নবদিগন্ত

মীর আব্দুর আলীম


বাংলাদেশ আজ এক অনন্য ও ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়ে আমরা এমন এক জনপদের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে রাজনীতির অর্থ হবে জনসেবা, কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর হাতিয়ার নয়। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ প্রতিহিংসা আর বিভাজনের কালো মেঘে ঢাকা ছিল। ক্ষমতার দম্ভ আর প্রতিপক্ষকে নির্মূলের অশুভ প্রতিযোগিতায় আমরা বারবার পথ হারিয়েছি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সুর ধ্বনিত হচ্ছে, তা দেশের বোদ্ধা সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনে নতুন এক আশার সঞ্চার করেছে। তিনি বারবার বলছেন, “ভবিষ্যত বাংলাদেশে প্রতিহিংসার কোনো স্থান নেই।” এই অঙ্গীকার যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে তা হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক অপরিহার্য অক্সিজেন।

গণতন্ত্রে মতভেদ থাকবেই, কিন্তু সেই ভিন্নমত যেন ব্যক্তিগত শত্রুতায় রূপ না নেয়। গত কয়েক দশকে আমাদের রাজনীতিতে ‘উইনার টেকস অল’ বা ‘বিজয়ীর সব দখল’ করার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খেয়েছে। এই বিভাজন কেবল রাজনৈতিক দলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সাধারণ মানুষকেও বিভক্ত করে ফেলেছিল। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার যে বলিষ্ঠ প্রতিশ্রুতি দেখা গেছে, তা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আক্রোশের রাজনীতি কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে এবং রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। প্রতিহিংসার আবাদ বন্ধ না হলে প্রকৃত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষ আজ এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ চায়, যেখানে যুক্তি আর তর্কের খাতিরে একে অপরের সমালোচনা হবে, কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই ধ্বংসাত্মক না হয়। আগামীর রাজনীতি হওয়া উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধার।

একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি মনে করি, গত দেড় দশকে সাংবাদিকতা পেশার মেরুদণ্ড পরিকল্পিতভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংবাদ সম্মেলনগুলো একসময় কেবল ‘স্তুতি সম্মেলনের’ মহড়ায় পরিণত হয়েছিল। প্রশ্ন করার চেয়ে তোষামোদির যে কুৎসিত প্রতিযোগিতা আমরা দেখেছি, তা সাংবাদিক সমাজকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানরা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন সত্য উন্মোচনের জন্য, স্রেফ প্রশংসা শোনার জন্য নয়। সাংবাদিকতার মূল শক্তি হলো ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা। যখন একজন সাংবাদিক ভয়হীনভাবে প্রশ্ন করতে পারবেন, তখনই রাষ্ট্রের ভুলত্রুটিগুলো শোধরানোর সুযোগ তৈরি হবে। তথ্য অধিকার আইনের পূর্ণ প্রয়োগ এবং মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ছাড়া কোনো গণতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।

রাজনীতি কেবল ক্ষমতা দখলের বা মসনদে বসার লড়াই নয়, বরং জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের একটি মাধ্যম। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য। তারেক রহমান যে নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলছেন, সেখানে জনগণের ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জবাবদিহিতাহীন রাজনীতি একটি দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। প্রতিটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তার এলাকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতে হবে। যখন ব্যক্তিগত পকেট ভরার রাজনীতি ছাপিয়ে দেশপ্রেম আর মানুষের হাহাকার দূর করার ইচ্ছা বড় হয়ে ওঠে, তখনই একটি রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

এদেশের মানুষ দীর্ঘকাল গুম, খুন আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের যে অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা সভ্য সমাজের জন্য চরম কলঙ্ক। প্রতিটি নাগরিক যেন তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে হেনস্তার শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধান সাংবিধানিক দায়িত্ব। পুলিশের পোশাকে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ বন্ধ না হলে রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে না। আমাদের স্বপ্ন এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে পুলিশকে দেখে মানুষ ভয় পাবে না বরং নিরাপত্তা অনুভব করবে।

দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। সরকারি প্রতিটি দফতরে সামান্য কাজের জন্য ঘুষ দেওয়া এখন যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই পদ্ধতিগত দুর্নীতি সমাজকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তারেক রহমান যে নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলছেন, সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট করার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। যখন মেধা আর সততার ভিত্তিতে পদায়ন হবে, তখনই আমলতন্ত্রে গতি ফিরবে।

দেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঋণের নামে জনগণের আমানত লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই আস্থার সংকট দূর করতে হলে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরণের ‘অপারেশন’ প্রয়োজন। রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে বড় বড় ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়। ব্যাংকের টাকা যেন সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কাজে লাগে, তা নিশ্চিত করাই হবে আগামীর সরকারের প্রধান পরীক্ষা।

সাধারণ মানুষের পিঠ আজ দেওয়ালে ঠেকে গেছে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যের কারণে। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে লালিত অদৃশ্য বাজার সিন্ডিকেট। আমরা চাই এমন এক উন্মুক্ত বাণিজ্যিক পরিবেশ যেখানে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না, থাকবে না কোনো চাঁদাবাজি। ছোট-বড় সব উদ্যোক্তা যেন সমান সুযোগ পায়। ব্যবসার জন্য লাইসেন্সিং পদ্ধতি সহজ করতে হবে এবং ওয়ান-স্টপ সার্ভিস কার্যকর করতে হবে। স্বস্তির বাজার আর সহজ ব্যবসা—এই দুইই হবে সমৃদ্ধ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো তার শিল্প খাত। কিন্তু জ্বালানি সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেক কারখানা আজ বন্ধের পথে। শিল্পবান্ধব নীতিমালা তৈরি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ। এই ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’কে কাজে লাগাতে হলে কারিগরি শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে। তরুণদের মেধা বিকাশে কোটা নয়, যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। মেধাবীরা যেন দেশ ছেড়ে চলে না যায়, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে ২০৫০ সালের উন্নত বাংলাদেশের কারিগর হবে এই তরুণ প্রজন্মই।

ন্যায়বিচার পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বিচার বিভাগকে যখন নির্বাহী বিভাগের শাখা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন মানুষ আস্থার জায়গা হারায়। এই কলঙ্কিত ইতিহাস মুছতে হলে বিচার বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। যখন একজন সাধারণ রিকশাচালকও এই বিশ্বাস পাবেন যে তিনি রাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আদালতে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার পাবেন, তখনই বুঝব দেশে আইনের শাসন কায়েম হয়েছে।

প্রতিহিংসার রাজনীতি কেবল বিভাজন আর ধ্বংস নিয়ে আসে। সময় এসেছে প্রতিহিংসার কবর দিয়ে ভালোবাসার এবং জনসেবার রাজনীতি শুরু করার। একটি দেশের উন্নয়ন কেবল ফ্লাইওভার বা বড় ভবনের চাকচিক্য নয়, বরং মানুষের মর্যাদা এবং আস্থার নাম। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে যে পরিবর্তনের অঙ্গীকার দেখা যাচ্ছে, দেশবাসী তার বাস্তব প্রয়োগ দেখতে চায়। আমরা আর পেছনে তাকাতে চাই না। আমরা এক নতুন ভোরের প্রত্যাশা করছি—যেখানে কোনো ভয় থাকবে না, কোনো দুর্নীতি থাকবে না, থাকবে শুধু সাম্য আর সমৃদ্ধি। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হোক নিরাপদ, গণতান্ত্রিক এবং বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক স্বাবলম্বী দেশ।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test