E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

প্রবাসী শ্রম বাংলাদেশের নীরব অর্থনৈতিক শক্তির স্তম্ভ 

২০২৫ ডিসেম্বর ৩০ ১৭:৩২:১৫
প্রবাসী শ্রম বাংলাদেশের নীরব অর্থনৈতিক শক্তির স্তম্ভ 

ওয়াজেদুর রহমান কনক


একটি দেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার গভীরে এমন কিছু অবদান থাকে, যা দৃশ্যমান অবকাঠামোর মতো চোখে পড়ে না, কিন্তু নীরবে রাষ্ট্রকে সচল রাখে। দেশের সীমানার বাইরে অবস্থানরত শ্রমশক্তির পাঠানো অর্থ, অর্জিত দক্ষতা ও বহন করা অভিজ্ঞতা সেই নীরব শক্তির অন্যতম প্রকাশ। এই শ্রম শুধু ব্যক্তিগত জীবিকার প্রশ্ন নয়; এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করা, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক গতিশীলতা তৈরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বহু পরিবারে শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার পেছনে রয়েছে এই বৈশ্বিক শ্রমপ্রবাহের অবিচ্ছিন্ন অবদান।

একই সঙ্গে এই অবদান রাষ্ট্রকে নতুন নীতিগত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। শ্রমবাজারের বৈশ্বিক চাহিদা, অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, মানবিক সুরক্ষা ও মর্যাদার প্রশ্ন—সবকিছু মিলিয়ে এটি কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং সামাজিক ন্যায় ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতারও প্রতিফলন। বৈদেশিক শ্রমের ওপর নির্ভরতা যেমন উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করে, তেমনি এটি দক্ষতা উন্নয়ন, নিরাপদ অভিবাসন ও প্রবাসী কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনে। এই বাস্তবতা বোঝা মানে একটি দেশের উন্নয়নকে কেবল ভৌগোলিক সীমার মধ্যে নয়, বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা।

৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় প্রবাসী দিবস হিসেবে স্মরণ করা হয় মূলত রাষ্ট্র গঠনে প্রবাসী কর্মীদের ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে। এই দিবসটি কেবল আনুষ্ঠানিক স্মরণ নয়; বরং এটি রাষ্ট্র, পুঁজি, শ্রম ও অভিবাসনের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক উপলক্ষ। বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিহাসে প্রবাসী কর্মীরা এমন এক নীরব স্তম্ভ, যার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার, গ্রামীণ অর্থনীতির সঞ্চালন এবং অসংখ্য পরিবারের সামাজিক গতিশীলতা।

প্রবাসী শ্রমের ধারণাটি কেবল কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধ অর্থে দেখা হলে এর গভীরতা অনুধাবন করা যায় না। এটি মূলত একটি কাঠামোগত প্রক্রিয়া, যেখানে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অতিরিক্ত শ্রমশক্তি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে যুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক পুঁজির চাহিদা পূরণ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি আরও সংবেদনশীল, কারণ প্রবাসী কর্মীদের একটি বড় অংশ স্বল্প দক্ষ বা আধা-দক্ষ শ্রমিক, যারা মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের শ্রমনির্ভর অর্থনীতিকে সচল রাখছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স কেবল অর্থনৈতিক প্রবাহ নয়; এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তা বলয়, যা গ্রাম থেকে শহর, দরিদ্রতা থেকে মধ্যবিত্তে উত্তরণের পথ প্রশস্ত করেছে।

জাতীয় প্রবাসী দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রবাসী কর্মীদের অবদান শুধু জিডিপি বা রিজার্ভের পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ নয়। প্রবাসী অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও গভীর ছাপ ফেলেছে। প্রবাস ফেরত শ্রমিকদের মাধ্যমে নতুন দক্ষতা, নতুন ভোগধারা, নতুন চিন্তা ও কখনো কখনো নতুন সামাজিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রের জন্য একদিকে সম্ভাবনা, অন্যদিকে দায়িত্বের প্রশ্ন তোলে—রাষ্ট্র কীভাবে এই মানবসম্পদকে সুরক্ষা দেবে, মর্যাদা দেবে এবং টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করবে।

এই দিবসের তাৎপর্য আরও গভীর হয় যখন আমরা প্রবাসী শ্রমের ঝুঁকি ও বঞ্চনার বাস্তবতা বিবেচনা করি। কর্মস্থলে শোষণ, চুক্তিভঙ্গ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক চাপ—এসব বাস্তবতা প্রবাসী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় প্রবাসী দিবস তাই কেবল প্রশংসার দিন নয়; এটি আত্মসমালোচনারও দিন। রাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি, কূটনৈতিক তৎপরতা, শ্রমচুক্তির কাঠামো এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সুযোগ এনে দেয় এই দিনটি।

জাতীয় প্রবাসী দিবস একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পাঠও দেয়। এটি আমাদের শেখায় যে উন্নয়নকে যদি কেবল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে প্রবাসী শ্রমের অবদান অবমূল্যায়িত হবে। বরং অভিবাসনকে উন্নয়নের একটি অবিচ্ছেদ্য কৌশল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই অভিবাসন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাই আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক ও রেমিট্যান্স সম্পর্কিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় যে বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রম শুধু ব্যক্তিগত জীবনের অংশ নয়, অর্থনীতির একটি নির্ভরযোগ্য ও বৃহৎ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি-২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১,১৬,৭২৫ জন কর্মী বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে গেছেন এবং তারা ১৫,৭৯১ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বিভিন্ন সময়ে রেকর্ড ভাঙা প্রবাহের একটি অংশ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই পরিমাণ রেমিট্যান্স ২০২৪ সালের একই সময়ে পাঠানো ১৩,৫৪৫ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে, যা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ফলে সম্ভব হয়েছে।

২০২৪ সালের পুরোটাই যদি দেখি, সেই বছরে প্রায় ১০,১১,৯৬৯ জন বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে চাকরি করেছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২৬,৮৮৯.৫৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এটি ২০২3 সালের ২৬,৮৮৯.৫৪ মিলিয়নের তুলনায় স্থিতিশীল বা কিছুটা উন্নত প্রবণতা প্রদর্শন করে, যদিও কর্মী সংখ্যা ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির গতি প্রতি বছর ভিন্ন মাত্রা ধারণ করে।

দীর্ঘ মেয়াদি পরিবর্তনগুলোও প্রবাসী অর্থের গুরুত্ব তুলে ধরে; গত এক দশক ধরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রায় ডবল হয়েছে — ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রায় ১০.৯৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স থাকলেও ২০২৩-২৪-এ তা ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা প্রবাসী কর্মীদের মোট অবদানের ধারাবাহিক বর্ধনের প্রমাণ।

বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে কাজ করছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গিয়ে থাকেন মধ্যপ্রাচ্য ও অভ্যন্তরীণ দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে; উদাহরণস্বরূপ ২০২৫ সালে সৌদি আরবে ৭৪৪,৬১৯ জন, কাতারে ১০৬,৮০৫ জন এবং সিঙ্গাপুরে ৬৯,৪৯১ জন কর্মী গিয়ে পড়েছেন।

অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায় গবেষণা দেখায় যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী প্রবাসী শ্রমিকরা বর্তমানে দেশের মোট কর্মসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করে এবং তারা প্রায় ৭.৫ থেকে ৮ মিলিয়ন সক্রিয় শ্রমিক হিসেবে বিদেশে কাজ করছেন, যা দেশের সামগ্রিক কর্মসংস্থানের প্রায় ১১–১১.৭% হিসাবে ধরা হয়।

এই পরিসংখ্যানগুলি বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রমিক ও রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরতা, তাদের সংখ্যা ও পাঠানো অর্থের পরিমাণ কীভাবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক বিকাশে এই রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ নয়; এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, গ্রামীণ বিনিয়োগ, পরিবারভিত্তিক ব্যয় ও সঞ্চয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে, সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩১ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test