E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী: বিদায় ও স্মরণ

২০২৫ ডিসেম্বর ৩১ ১৭:০০:৪৮
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী: বিদায় ও স্মরণ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আজ এক গভীর শূন্যতার দিন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী সরকার প্রধান এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ইংরেজি সাল। সকালে দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালের তাঁর বয়স ৮০ বছর। দীর্ঘদিনের বার্ধক্যজনিত ও জটিল শারীরিক সমস্যার মধ্যেও তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর মর্যাদা, ধৈর্য এবং দায়িত্ববোধ বজায় রেখেছিলেন। দেশের রাজনীতিতে তার অবদান ছিল এক অনন্য ও স্মরণীয় অধ্যায়।

বেগম খালেদা জিয়ার জীবন ছিল এক অবিচল যাত্রা—দায়িত্ব, নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও মানবিকতার এক অনন্য মেলবন্ধন। তিনি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একটি সময়ের, একটি রাজনৈতিক ধারার এবং নারীর নেতৃত্বের এক শক্তিশালী প্রতীক।

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি

বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়ি-তে। বিএনপি এই তথ্য জানিয়েছে। তাঁর বাবা ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা তৈয়বা মজুমদার। পরিবারের আদি ভিটা ছিল ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলায়, এবং তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিলেন দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া এলাকায়।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে খালেদা জিয়া ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বড় দুই বোন এবং ছোট দুই ভাই। ঘনিষ্ঠ ও বিএনপির নেত্রী সেলিমা রহমান জানিয়েছেন, রাজনীতি নিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও খালেদা জিয়া পারিবারিক কর্তব্য পালনে সবসময় সক্রিয় ছিলেন।শৈশব ও কৈশোরে তিনি ছিলেন শান্ত, সংযত এবং দায়িত্বশীল। শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক মূল্যবোধ ও শালীনতা ছিল তাঁর চরিত্রের মূল ভিত্তি।

শিক্ষা ও দাম্পত্য জীবন

তিনি নিজ জেলা ও পরবর্তী সময়ে কলেজ পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেই ছিল তাঁর প্রধান মনোযোগ। ১৯৬০ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান-এর সঙ্গে। এই দাম্পত্য সম্পর্ক পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধ্যায়ের ভিত্তি গড়ে দেয়। তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় দুই পুত্র—তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকো। একজন গৃহিণী হিসেবে সংসার ও সন্তান প্রতিপালনই ছিল তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারকে সমর্থন দেওয়া, সন্তানদের প্রতি স্নেহশীল থাকা এবং ঘরোয়া দায়িত্ব পালনে তিনি সবসময় নিবেদিত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এক গভীর ও স্মরণীয় অধ্যায়। এই সময় তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও তিনি সন্তানদের নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটান। এই সময়ের ধৈর্য, ত্যাগ এবং আত্মসংযম তাঁর ব্যক্তিত্বকে আরও দৃঢ় করে তোলে।মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময় তাঁর সাহস, সহনশীলতা এবং মানসিক শক্তি দেশের মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

জীবনের মোড় পরিবর্তন

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এক গভীর শোক এবং নতুন রাজনৈতিক দায়িত্বের সূচনা করে। ব্যক্তিগত বেদনার মধ্যেও সময় ও দেশের প্রয়োজনে তাঁকে এগিয়ে আসতে হয়।১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এখান থেকেই তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। শুরুর দিকে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ নারী, কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তিনি দৃঢ়, সংযত এবং দায়িত্বশীল নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব

আশির দশকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করেন। আন্দোলন, কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে তিনি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে তাঁর নেতৃত্বের ধৈর্য, সংযম এবং দৃঢ় মনোবল দেশের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী

১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কেবল রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং নারীর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি। তিনি মোট তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন—১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি দৃঢ়তা, শালীনতা এবং অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।

রাষ্ট্র পরিচালনায় অবদান

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সময়কালে শিক্ষা বিস্তার, অবকাঠামো উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় তিনি গতিশীলতা এনেছেন।আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বাংলাদেশের মর্যাদাশীল প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দেশের ভাবমূর্তিতে এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয়।

বিরোধী নেত্রী হিসেবে ভূমিকা

ক্ষমতার বাইরে থেকেও বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সক্রিয় ও সংগঠিত বিরোধী নেত্রী। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে তিনি দৃঢ় অবস্থান নিতেন। দল ও নেতাকর্মীদের তিনি ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

অসুস্থতা ও শেষ সময়

জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। বয়সজনিত অসুস্থতার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। শেষ সময়ে পরিবার ও নিকটজনদের সান্নিধ্যে ছিলেন।মঙ্গলবার সকালে তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ দেশে গভীর শোকের আবহ সৃষ্টি করে।

ব্যক্তিগত বেদনা

রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি গভীর শোক বহন করেছেন। কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু তাঁর জীবনের এক বড় আঘাত। এই শোক নিয়েই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পথ চলেছেন।

রাজনৈতিক উত্তরাধিকার

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন মর্যাদাশীল, দৃঢ় এবং প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তিনি নারীর নেতৃত্বকে শক্তিশালী করেছেন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর সক্ষমতার এক শক্তিশালী উদাহরণ হয়ে থাকবেন।

পরিশেষে বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার বিদ্যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক শক্তিশালী কণ্ঠ নীরব হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন একজন দৃঢ়সংকল্পী নেত্রী, যিনি দেশের গণতন্ত্রকে দৃঢ় করার পাশাপাশি নারীর নেতৃত্বের সম্ভাবনাকে সুদৃঢ় করেছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ধাপে দায়িত্ব, ধৈর্য ও নৈতিকতা বজায় রেখে তিনি নিজেকে জনগণের আস্থা ও আশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ইতিহাসে স্বতন্ত্র স্থান রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর দৃঢ়তা, নীতি-প্রতিশ্রুতি এবং শালীনতা দেশের মানুষের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি দেশের কল্যাণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্থায়ী রক্ষা করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন মানবিক ও নিবেদিত। পরিবার এবং সন্তানদের প্রতি তিনি সর্বদা যত্নশীল ছিলেন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পারিবারিক কর্তব্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই মানবিক দিক তাঁর নেতৃস্থানীয় চরিত্রকে আরও প্রভাবশালী করেছে।আজ তাঁর ইন্তেকাল দেশের জন্য এক গভীর শোকের মুহূর্ত। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। আমরা প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর আত্মাকে শান্তি দান করুন, জান্নাতুল ফেরদৌসে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করুন এবং পরিবারকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শক্তি দিন।

সময় এগিয়ে যাবে, নতুন নেতৃত্ব দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার নাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থায়ীভাবে লেখা থাকবে। একজন সংগ্রামী, মর্যাদাশীল এবং আত্মনিবেদিত নেত্রী হিসেবে তাঁর অবদান ও স্মৃতি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

৩১ ডিসেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test