E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

কৃষিতে নারীর ভূমিকা: ক্ষমতায়নের পথ ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ

২০২৫ আগস্ট ১২ ১৮:০২:২৭
কৃষিতে নারীর ভূমিকা: ক্ষমতায়নের পথ ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ

ওয়াজেদুর রহমান কনক


বাংলাদেশের কৃষি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের অবদান এখনও সমানভাবে স্বীকৃত নয়। দেশের মোট কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭% নারী, যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালের কৃষি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারীরা ধান, শাকসবজি, ফলমুল এবং পশুপালনে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে নারীদের প্রায় ৬৫% কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকেন, যেখানে তারা বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল তোলা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত নানা কাজ সম্পাদন করেন। যদিও নারীদের দৈনিক মজুরি পুরুষদের তুলনায় ২০-৩০% কম, তাদের শ্রম ও দক্ষতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে অপরিহার্য অবদান রাখে। নারীদের কৃষিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভিত্তি সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে নারীদের ঐতিহাসিক বাস্তবতা দীর্ঘ এবং জটিল। পুরাতন কাল থেকেই নারীরা পরিবার ও সমাজের একান্ত অংশ হিসেবে কৃষিকাজে নিযুক্ত থেকেছেন, যদিও তাদের অবদান প্রায়ই অদৃশ্য থেকে গেছে। ইতিহাসে দেখা যায়, নারীরা প্রধানত গৃহস্থালি কৃষি ও বাগানপালনে সক্রিয় ছিলেন। তারা বীজ সংরক্ষণ, বপন, ফসলের যত্ন, পশুপালন, এবং কৃষি উৎপাদনের নানা স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।

প্রাচীন সমাজে নারীদের কাজ ছিল কৃষি প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত হলেও পুরুষ কেন্দ্রিক সামাজিক কাঠামোর কারণে তাদের শ্রমকে মূল্যায়ন করা হতো কম। কৃষি উৎপাদনের ফলাফলে নারীদের অবদানকে প্রায়ই পরিবার বা সমাজে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপেক্ষা করা হতো। মধ্যযুগ এবং ঔপনিবেশিক যুগে এই ধারা কিছুটা স্থির থাকে, যদিও নারীরা ধান চাষ, শাক-সবজি উৎপাদন ও পশুপালনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতেন।

ঔপনিবেশিক শাসনের সময় কৃষিতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে নারীদের অংশগ্রহণেও পরিবর্তন আসে, তবে এটি মূলত সীমিত ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, নারীরা অবহেলিত থেকে গৃহস্থালি ও সহায়তাকারী কৃষিকর্মেই নিয়োজিত ছিলেন। ২০শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে নারীদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির ফলে তারা কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। এটি নারীদের সক্ষমতা ও স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন নীতিতে নারীদের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও বাস্তবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে নারীদের ভূমিকা সীমিত ছিল। পরবর্তীতে নারী-কেন্দ্রিক কৃষি প্রকল্প ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের অবদান স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। নারীরা শুধু শ্রমিক হিসেবেই নয়, বরং ক্ষুদ্র উদ্যোগপতি, কৃষি প্রযুক্তিবিদ, বীজ ও প্রজনন উপকরণ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, নারীরা কৃষির প্রাথমিক ধাপ থেকে শুরু করে উৎপাদনের সব স্তরে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন, তবে তাদের অবদান সামাজিক কাঠামো ও পুরুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রায়শই হারিয়ে গেছে। বর্তমানের কৃষি উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক এই অবদান নতুন আলোকে পুনর্মূল্যায়ন ও সমর্থন প্রয়োজন।

বাংলাদেশের কৃষি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান বিষয়। যদিও নারীরা কৃষিতে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত, তাদের অবদান প্রায়ই অদৃশ্য থাকে এবং সমান সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের কৃষি খাতে অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করতে সহায়তা করছে।

বাংলাদেশের মোট কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭% নারী। ২০০৫ সালে নারীদের কৃষি খাতে অংশগ্রহণ ছিল ৩৬.২%, যা ২০১৯ সালে বেড়ে ৪৫.৩% হয়েছে, যা বিশ্বের অন্যান্য কৃষিনির্ভর দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে নারীদের কৃষিতে অংশগ্রহণের হার ৫৮% থেকে ৬৬% এ উন্নীত হয়। এই প্রবণতা মূলত পুরুষদের শহরে অভিবাসন এবং নারীদের কৃষি ব্যবস্থাপনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে ঘটেছে।

নারীরা কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা বীজ বাছাই, বপন, সেচ, আগাছা পরিষ্কার, ফসল তোলা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, এবং পশুপালনসহ ১৭টি কৃষি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে গৃহস্থালি কৃষিতে নারীদের অবদান অপরিসীম। তবে তাদের শ্রম প্রায়ই অদৃশ্য থাকে এবং তারা কৃষক হিসেবে স্বীকৃত নন।

নারীদের কৃষি খাতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাদের অধিকাংশই কৃষি যন্ত্রপাতি ও আধুনিক প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত। ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে মাত্র ১৫% কৃষক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এই হার প্রায় ৭০%। এছাড়া, নারীদের দৈনিক মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম, যা সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন।

নারীদের কৃষি খাতে অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। পুরুষদের শহরে অভিবাসন, নারীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি, এবং কৃষি ব্যবস্থাপনায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই প্রবণতা ত্বরান্বিত করেছে। তবে, নারীদের কৃষি খাতে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

সার্বিকভাবে, নারীরা বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে, তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন, সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নারীদের কৃষি খাতে পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, সম্প্রদায় এবং সমাজের সক্রিয় ভূমিকা পালন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কৃষিতে নারীদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিসীম, যা প্রান্তিক হলেও দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জীবনদায়ী ভূমিকা পালন করে চলেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক অংশ নারী কর্মী দ্বারা পূরণ হয়। নারীরা কৃষির বিভিন্ন ধাপে, যেমন বীজ বপন, সেচ, ফসল তোলা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পশুপালনে সরাসরি যুক্ত থাকেন।

গ্রামীণ অঞ্চলে নারীদের অংশগ্রহণ শতকরা প্রায় ৬৫-৭০ ভাগ, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্ব বহন করে। তবুও, তাদের আয় পুরুষদের তুলনায় প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কম এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের প্রবেশাধিকার সীমিত। এই বৈষম্য দূর করে নারীদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের পূর্ণাঙ্গ ও সমান অধিকারভিত্তিক অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের টেকসই কৃষি উন্নয়ন অপ্রতুল থাকবে। তাই নারীদের কৃষিতে সম্পৃক্তি শুধু একটি সামাজিক প্রয়োজন নয়, বরং দেশের সার্বিক প্রগতি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ স্বীকার করা অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ নারীরা বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনের এক অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের শ্রম এবং দক্ষতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীদের অবদান স্বীকৃত না হলে তারা প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে, নারীদের অংশগ্রহণ স্বীকার করলে তাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পায়, ফলে তারা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতিতে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। এটি কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।

তদুপরি, নারীদের অবদানের স্বীকৃতি নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে। নারীদের শ্রমকে উপেক্ষা করলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরও গভীর হয়, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

সুতরাং, কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ স্বীকার করাই কেবল ন্যায়সঙ্গত নয়, এটি বাংলাদেশের স্থায়ী কৃষি উন্নয়ন ও সামাজিক সুবিন্যস্ততার জন্য অপরিহার্য।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।

পাঠকের মতামত:

১২ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test