E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নদীতে কুড়িয়ে পাওয়া পাতায় হাড়ি জ্বলে তরী বালার

২০২৫ জুন ২২ ০০:৩২:৫৪
নদীতে কুড়িয়ে পাওয়া পাতায় হাড়ি জ্বলে তরী বালার



রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ  ইউনিয়নের দক্ষিণ কদমতলা গ্রামের সত্তরের বেশী বয়সী তরী বলাকে দেখা যায় বনের পাতা কুড়াতে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,আমাগো এছাড়া উপায় নেই। এই বনের পাতা জ্বলালি আমাগো হাড়ি জ্বলে।

ছয় জনের সংসারে মালঞ্চ নদীর থেকে পাতা কুড়িয়ে চলে সারা বছরের জ্বালানী। জীবন স্বায়েন্বে অসতী পর বৃদ্ধ বয়সে জ্বালানি কুড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে প্রায় ৩০ বছর চলছে তার জীবন।উপকূল জুড়ে জ্বালানি সংকট।বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে সুন্দরবন নির্ভরশীল এলাকাতে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে।

উপকূলের আরেক বৃদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, বনে গিলি ফরেষ্টাররা ধরে মামলা দেয়, আইলা’র পর থেকে গোটা এলাকা যেন বিরাভূমি। একটু জ্বালানীর জন্যি তাই আমরা পানিতে ভেসে আসা পাতা কুড়াচ্ছি’। কথাগুলো শেষ হতেই গলুইঠেলা হাতে নিয়ে আবারও পানিতে নেমে পড়েন হিরা বেগম।পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী চার সন্তানেরর জননী এ নারী পানির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আরও বলেন, আমাগা কোন আয় নি। এলাকায় এটটা বড় লোকের বাড়ি নি, টাউন বন্দর নি, আমারা খাবো কি, চলবো কেমবায় (কিভাবে)’। ‘জোয়ারে ভেসে আসা কুড়ানো পাতা দে চুলতেছে (চলছে) আমাগা জীবন’।‘খুব কষ্ট ভাই জ্বালানীর- উল্লেখ করে অনতিদুূর থাকা রফিকুল ইসলাম জানায়, কুড়ানো পাতা মুলত তারা জ্বালানীর কাজে ব্যবহার করে। আবার অসংখ্য মানুষ নদীতে ভেসে আসা এসব পাতা কুড়িয়ে নিয়ে শুকিয়ে বিক্রি করে সংসারের খরচ যোগাচ্ছে। পশ্চিম কৈখালী গ্রামের বাসিন্দা রফিকুলের দাবি এলাকায় কাজকর্ম নেই। বাধ্য হয়ে হাঙর ও কামোটের ভয়ডর উপেক্ষা করে দিনরাত নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা।

রফিকুল আরও বলেন, ‘একার আয়ে বৃদ্ধ মা-বাপসহ সাত মুখের যোগান দিতি হয়। মাঝেমধ্যে চাল-ডালির ব্যবস্থা হলিও জ্বালানি জোটে না। তাই প্রতিদিন নদীতে জোয়ার শুরু হলি গলুইঠেলা নিয়ে নদীতে আমাগো নামতি হয়’।তবে শুধুমাত্র হিরা বেগম,তরী বালা, আর রফিকুল ইসলাম না। বরং জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা পাতা কুড়িয়ে জ্বালানীর চাহিদা পুরণের পাশাপাশি সংসার চালানো পরিবারের সংখ্যা অসংখ্য। কৈখালী থেকে শুরু করে মুন্সিগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালীনি হয়ে গাবুরা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এ জনপদের হাজারও পরিবারের অন্যতম পেশায় পরিনত হয়েছে পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের পাতা কুড়ানো।

পাতা কুড়ানোর কাজে জড়িতরা জানায় পাতার সাথে সুন্দরবনের নানান প্রজাতির গাছের ফুল ও ফল থাকে। যে কারনে বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে এমন কাজ করতে হয় তাদের। তবে সমগ্র এলাকাজুড়ে জ্বলানী সংকটে প্রকট হওয়ার দরুন তারা এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

খলিশাবুনিয়া গ্রামের রাশিদুল ইসলাম বলেন, পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এলাকায় চিংড়িঘের থাকায় কাজকর্ম নেই। বাধ্য হয়ে স্ত্রীসহ নিজে নদীতে মাছের রেণু ধরে সংসার চালাতেন। তবে জুন মাসের শুরু থেকে নদীতে নামা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন জোয়ারে ভেসে আসা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে গৃহস্থদের কাছে বিক্রি করছেন।

প্রায় অভিন্ন দাবি মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহড়তলী গ্রামের রেনুকা মন্ডলসহ আরও অনেকের। সুন্দরবন তীরবর্তী অংশে বসবাসরত এসব গ্রামবাসী জানায় আইলার পর থেকে প্রায় গাছ-গাছালি শুন্য হওয়ায় এলাকায় তীব্র জ্বলানী সংকট। মাঝেমধ্যে জেলেরা মাছ-কাঁকড়া ধরার সুযোগে সুন্দরবন থেকে কিছু জ্বালানী সংগ্রহ করে। ধনী পরিবারগুলো শহরাঞ্চল কিংবা বরিশাল এলাকা থেকে নৌ-পথে আসা জ্বালানী ক্রয় করে প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। তবে উপকুলপাড়ে বসবাসরত হাজারও পরিবারের অন্যতম প্রধান জ্বালানী জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের পাতা, ফুল ও ফল। তবে এসব উপকুলবাসীর ভয় পাতা সংগ্রহের কাজ বন্ধ হলে জীবন চালানো তাদের আরও কঠিন হয়ে যাবে। ক্রয় ক্ষমতা না থাকার পাশাপাশি তীব্র জ্বালানী সংকটের মধ্যে পড়ে রীতিমত বাস্তচ্যুত হওয়ার মত পরিস্থিতির শংকায় তারা। নদীতে ভেসে আসা পাতা নির্বিঘ্নে সংগ্রহে প্রশাসনিক অনুমতির দাবি তাদের।

এসব বিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান বলেন, সুন্দরবনের পাতা ফুল ও ফল সাধারনত সেখান প্রাণী ও মাছদের খাদ্য। তাছাড়া অনেক সময় জোয়ারের পানিতে ভেসে সেগুলো বিভিন্ন চরে যেয়ে প্রাকৃতিকভাবে বনভুমির সৃষ্টি করে। জ্বালানীর জন্য অবশ্যই উপকুলবাসীকে বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তা করতে হবে।

(আরকে/এএস/জুন ২২, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test