E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

লক্ষ্মীপাশার সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির ঐতিহ্যের ধারক ও পুণ্যস্থান

২০২৫ জুলাই ২০ ১৭:৫৫:৩১
লক্ষ্মীপাশার সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির ঐতিহ্যের ধারক ও পুণ্যস্থান

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক শতাব্দী প্রাচীন লোহাগড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র লক্ষ্ণীপাশার শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা মন্দির। প্রাচীন নিদর্শন আর ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে সগৌরবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থাপনাটি।

নবগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রায় চারশ বছরের পুরনো এই কালী দেবী ' শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী' নামে পূজিত হয়ে আসছেন। প্রতিদিন এ পুণ্যস্থানে পূজা-অর্চনা, নিত্য ভোগরাগ, পাঠাবলিসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়ে আসছে।

বাংলা ভাষাভাষি অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী নর-নারী লক্ষ্ণীপাশার এই শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে নিজেদের 'ত্রাণকর্ত্রী' হিসেবে মনে করেন। প্রতিদিন শত শত ভক্তের আগমন ঘটে এই পুণ্যস্থানে। প্রায় ১৮৩ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। কালের স্বাক্ষী শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা মন্দির অন্যতম প্রাচীনতম নিদর্শন।

মূল মন্দিরে স্থাপিত শ্বেত পাথরের ফলক, ইতিহাস, প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজি ১৬৪৩ সাল, বাংলা আনুমানিক ১০২৫ বঙ্গাব্দে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার ঝাঁপা মম্মিননগর গ্রামের রত্নেশ্বর চক্রবর্তীর ছেলে কামদেব চক্রবর্তী সংসার জীবন ছেড়ে তীর্থ ভ্রমণে বের হন। বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ শেষে জয়পুর পরশমনি মহাশ্মশানে 'কালী' সাধনায় ব্রত হন তিনি।

কামদেব চক্রবর্তী ছিলেন সাধক প্রকৃতির মানুষ। তিনি স্বীয় সাধনাবলে সিদ্ধিলাভ করেন এবং শ্মশানের অপর প্রান্তে নবগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে লক্ষ্ণীপাশা গ্রামে বর্তমান মন্দির প্রাঙ্গণে ছোটো একটি মন্দির নির্মাণ করে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতার 'বিগ্রহ' বা 'মূর্তি'তে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে কামদেব মাতৃ পূজায় মগ্ন হন।

এখানে আজও হরিতকি, বহেরা, আমলকি, তমাল ও বট-পাঁকুড় গাছের সংমিশ্রণে একটি প্রাচীন বেদি রয়েছে যেটি 'কামনাবৃক্ষ' বলে পরিচিত। সেখানে ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য শিবমূর্তি অঙ্কিত 'টালি' (মাটির তৈরি) বেঁধে দেন এবং মনোবাসনা পূর্ণ হলে সেই টালি খুলে নেন।

১৮১৮ সালে পাইকপাড়া এস্টেটের ফৌজদার বোলাকি সিংহ দাস নীলকর সাহেবদের পত্তনী হতে মুক্ত করার কাজে লোহাগড়ায় আগমন করে এই মন্দিরে অবস্থান করেন। ১৮৪৪ সালে বোলাকি সিংহ দাস নিজে উদ্যোগী হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের সহযোগিতায় বর্তমান পাকা মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ইংরেজি ১৯০১ ও বাংলা ১৩০৮ সালে শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কামদেবের বংশধর শীতল চন্দ্র চক্রবর্তী মূল মন্দিরের পূর্ব পাশে শিব মন্দির নির্মাণ করেন। এরপর তিনি ১৯১৯ সালে মূল মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের পশ্চিম পাশে যাত্রী নিবাস ও নবগঙ্গা নদীতে পাকা ঘাট নির্মাণ করেন।

প্রায় ৪৬ বছর পর ১৯৩৫ সালে মন্দিরটির পুনঃসংস্কার করে তৎকালীন লক্ষ্ণীপাশা গ্রামের কর্মকার বংশধররা মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্তে জমি দান করেন। এরপর দানকৃত জমিতে একটি বড় পুকুর খনন করে পাশের কাশিপুর গ্রামের নলিনী মুখার্জি ও রমনী মোহন মুখার্জি নামে দুই ভাইয়ের অর্থায়নে পুকুরের ঘাট পাকা করা হয়।

নব্বইয়ের দশকে মন্দিরটির পরিচালনা কার্যক্রম পারিবারিক বলয় থেকে বের হয়ে সর্বজনীন রূপ নেয় এবং স্থানীয় ধর্মানুরাগীদের সহযোগিতায় মন্দির পরিচালনার জন্য একটি গঠনতন্ত্র ও একটি পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়।

তিন বছর মেয়াদী পরিচালনা কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে এলাকাবাসী এবং ভক্তবৃন্দের সহযোগিতায় এই মন্দিরে প্রতিদিনকার নিত্য পূজা-অর্চনার পাশাপাশি বাৎসরিক কালী পূজা, দূর্গাপূজা, মহানামযজ্ঞানুষ্ঠান, জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠান, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি উদযাপনসহ অন্যান্য ধর্মীয় পূজার আয়োজন করা হয়।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমান পরিচালনা পরিষদের অধীনে নাট মন্দির, শিব মন্দির, বলিঘর সংস্কার, কেন্দ্রীয় রন্ধনশালা এবং সরকারি অর্থায়নে মায়ের ভোগরাগের জন্য একটি 'ভোগমন্দির' পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

কথা হয় শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সহ-সম্পাদক কিশোর রায় বলেন, এতদাঞ্চলের মানুষের কাছে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা মন্দিরটি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন। এলাকাবাসী ও ভক্তবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতায় এই মন্দিরটি আজ অনন্য উচ্চতার আসনে আসীন। প্রাচীন এই মন্দিরের পবিত্রতা, সংরক্ষণ, নিরাপত্তা এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

মন্দির পরিচালনা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রিয়াদ বলেন, এ অঞ্চলে অনেক প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা মন্দির অন্যতম। মন্দিরের সংরক্ষণ ও পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব সবার।

(আরএম/এসপি/জুলাই ২০, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test