E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

নব্য মীরজাফর, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ 

২০২২ এপ্রিল ০২ ১৮:০৬:১০
নব্য মীরজাফর, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ 

মোহাম্মদ ইলিয়াস 


জাতি হিসেবে বাঙালিকে সরাসরি রসিক জাতি বলা যাবে না হয়তো, কিন্তু বাঙালির রসবোধ বা ‘সেন্স অব হিউমার’ বেশ প্রবল। এর ব্যবহার আমরা প্রাত্যহিক জীবনেও দেখতে পাই। আশপাশের মানুষের ব্যবহার, সামাজিক রীতি, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাকে আমরা উপমা হিসেবে ব্যবহার করি। আবার কোনো কোনো সময় ব্যক্তির পরিচয়কে ঊর্ধ্বে রেখে সেই ব্যক্তির নামকে ব্যবহার করি বিশেষণ কিংবা হাস্যরসাত্মক বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক শব্দ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির চেয়ে আমরা বেশ এগিয়েই আছি বলা যায়। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ঐতিহাসিক চরিত্রের ব্যবহারেও আমরা সিদ্ধহস্ত। এই যেমন ‘মীরজাফর’ শব্দটি। এটি একটি ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও চরিত্রটির বিশ্বাসঘাতকতা পুরো নামটিকেই একটি গালিতে পরিণত করেছে। আমরাও প্রতিদিনের জীবনে চারপাশের বিশ্বাসঘাতক মানুষদের ‘মীরজাফর’ বলে ডেকে থাকি। আবার বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক হিসেবে ‘মীরজাফরি’ শব্দটিও ব্যবহার করতে দেখা যায়। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে এ শব্দ দুটি স্থান পেয়েছে কি না জানি না, তবে বহু দিন ধরেই বাঙালির দৈনন্দিন শব্দভান্ডারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে শব্দ দুটি। মানুষের কল্পনায়ও শব্দটির এমন একটি নেতিবাচক অবয়ব তৈরি হয়েছে যে, কোনো বাঙালি-ই তার সন্তানের নাম মীরজাফর রাখতে চায় না! যত দিন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস সজীব থাকবে, তত দিন পর্যন্ত এই নামটিও নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হবে। ভাষার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবহার নিয়ে আমি লিখতে বসিনি, আমি লিখছি মীরজাফর চরিত্রটির প্রেতাত্মাদের নিয়ে!

মীরজাফরের বিশ্বাস ভঙ্গের কাহিনি জানেন না- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ১৭৫৭ সালের কথা। জুন মাসের ২৩ তারিখ পলাশীর প্রান্তরে মুখোমুখি হয়েছে ইংরেজ সেনাবাহিনী ও নবাব সিরাজ-উদণ্ডদৌলার সৈন্যবহর। এই সেই সিরাজ-উদণ্ডদৌলা, ইতিহাসে যার নাম ঠাঁই পেয়েছে বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা নগণ্য। অস্ত্র, গোলাবারুদও ছিল নেহায়েতই কম। এর বিপরীতে নবাবের বহরে ছিল হাজার হাজার সৈন্য। ছিল কামানের মতো ভয়াবহ আগ্নেয়াস্ত্র। সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও ছিল ইংরেজ বাহিনীর তুলনায় অধিক। এই যুদ্ধে সিরাজ-উদণ্ডদৌলার জয় সুনিশ্চিত। নবাব খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না এ নিয়ে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নবাবের সেনাবাহিনী জয়লাভ করবে- এটি-ই ছিল অনুমেয়। কিন্তু যুদ্ধের দিন দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। নবাবের সৈনিকরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। আর ইংরেজদের পক্ষ থেকে মুহুর্মুহু হামলা চালানো হচ্ছে নবাবের শিবিরে। নবাব ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার প্রধান সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। নবাব সিরাজ-উদণ্ডদৌলার প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীরজাফর। এই সেই মীরজাফর, ২০০ বছর ধরে যার লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতার ফল ভোগ করেছে বাঙালি জাতি। মীরজাফর এসে নবাবকে উল্টাপাল্টা অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল। কিছু সময় পরই যুদ্ধ শুরু করবে- এমন আশ্বাসও দিল। কিন্তু এই যুদ্ধ ছিল মূলত নাটকের একটি দৃশ্যের মঞ্চায়ন, যে নাটকটি সাজিয়েছে চতুর ইংরেজ বণিক দল ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। আর এ নাটকের শেষভাগে পুরস্কৃত করা হয়েছে মীরজাফরকে। যুদ্ধের এই নাটক সাজানো হয়েছিল আরো কিছুদিন আগেই।

মীরজাফরের মনে ছিল নবার হওয়ার বাসনা। আর ইংরেজদের মনে ছিল সমগ্র বাংলাজুড়ে ব্যবসা ছড়িয়ে বাংলাকে দখল করার এক ভয়াল নীলনকশা। দুই পক্ষের এই মনোবাসনা এসে মিলিত হয়েছে পলাশীর প্রান্তরে। যুদ্ধের আগেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, মীরজাফর ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করবে না। বিনাযুদ্ধে ইংরেজরা যুদ্ধ জয় করে হত্যা করবে সিরাজ-উদণ্ডদৌলাকে। নতুন নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসানো হবে মীরজাফরকে। আর এর বিনিময় হিসেবে অঢেল অর্থের ভাগ পাবে ইংরেজ বণিকরা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই কাজ সম্পাদিত হয়। সিরাজ-উদণ্ডদৌলার মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসানো হয় মীরজাফরকে। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় মীরজাফরের শাসনকার্য পরিচালনা।

গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। চতুরতা আর বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজ-উদণ্ডদৌলাকে পরাজিত করেছিল মীরজাফর, কিন্তু এবার ইংরেজদের চাতুর্যে নিজেই হয়েছে পরাজিত। সিংহাসনে বসার অল্প কিছুদিনের ভেতরেই পাওনা টাকা নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে মীরজাফর। ইংরেজরা ছাড় দেওয়ার পাত্র নয়। যে ইংরেজদের হাত ধরে সিংহাসনে বসেছিল মীরজাফর, সেই ইংরেজরাই তাকে হটিয়ে দেয় সিংহাসন থেকে। এর পরও বছর কয়েকের জন্য ক্ষমতা পেয়েছিল মীরজাফর, কিন্তু সেটিও খুব বেশি সুখকর হয়নি। বরং তার এই ক্ষমতা পাওয়ার লোভই উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আধিপত্যের দরজা খুলে দিয়েছে। মীরজাফরের কারণেই ২০০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয়েছে এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষকে।

১৭৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করে মীরজাফর। কিন্তু ইতিহাসের নিকৃষ্ট এক চরিত্র কিংবা প্রচলিত শব্দভান্ডারের নিকৃষ্টতম গালি হিসেবে মীরজাফর যেন এখনো বর্তমান। বর্তমান তার আদর্শিক দোসররা। মরে গেলেও বিশ্বাসঘাতকের বেশে মীরজাফরের প্রেতাত্মারা যেন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের চারপাশজুড়ে। এই মীরজাফররা ছড়িয়ে আছে আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত। প্রতিনিয়ত তারা আমাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। বন্ধুবেশে সহমর্মিতা লাভ করে ঘাতকবেশে ছুরি বসাচ্ছে আমাদেরই শরীরে। দেশকে, দেশের ভাবমূর্তিকে করছে কলুষিত। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশকে ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এখনো চলমান। আর এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এ দেশীয় কিছু মীরজাফর। দেশকে, দেশের স্বার্থকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে এসব মীরজাফরকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ব্যক্তিজীবনেও এর রেশ ছড়িয়ে রয়েছে। বারবার নাজেহাল করছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে।

আমাদের আশপাশের মানুষের মধ্যে যে মীরজাফরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি বিদ্যমান, তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল এ দেশেরই কতিপয় বিশ্বাসঘাতক। হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণসহ প্রতিটি অপরাধের সঙ্গেই তারা জড়িত ছিল; বাঙালি হত্যায় শুরু থেকেই সহযোগিতা করে আসছিল পাকিস্তানিদের। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামক এই যুদ্ধাপরাধীরা তো মীরজাফরেরই অন্য একটি রূপ। নিজের স্বার্থে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল দেশের সঙ্গে। দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের তুলে দিয়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে। স্বাধীনতার পরও তারা ছিল সক্রিয়। স্বাধীন বাংলায় মীরজাফরদের আরেকটি ষড়যন্ত্রের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। এ দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আর এ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল এ দেশেরই কতিপয় বিশ্বাসঘাতক। এ যেন পুরোনো দৃশ্যেরই একাধিক পুনরাবৃত্তি। এই বিশ্বাসঘাতকরা কখনোই আমাদের পিছু ছাড়বে না। যুগে যুগে মীরজাফরের বেশে হামলে পড়বে আমাদের ওপর। এই মীরজাফরদের রুখে দিতে তাই হতে হবে বদ্ধপরিকর।ভালোবাসতে হবে সবুজ -শ্যামল সোনার বাংলা কে। একসাথে মোকাবিলা হবে সকল অপশক্তিকে; ভেঙে দিতে নব্য মীরজাফরদের সকল ইন্দ্রজাল।

লেখক : ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)।

পাঠকের মতামত:

০১ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test