E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বজ্রপাত ও তালগাছ: গ্রামীণ বাংলার প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

২০২৫ এপ্রিল ২৬ ১৮:১৩:০৫
বজ্রপাত ও তালগাছ: গ্রামীণ বাংলার প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ঘন ঘন বজ্রপাত হয়ে থাকে, যা প্রাণহানির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে খোলা মাঠে কাজ করা কৃষক, গবাদিপশু, শিশু-কিশোর, এমনকি পথচারীরাও বজ্রপাতের শিকার হন। সম্প্রতি বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার, যা এর ভয়াবহতা বোঝায়। এই প্রেক্ষাপটে প্রাচীন বাংলার একটি সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে—তালগাছ রোপণ।

>বজ্রপাত কী এবং কেন হয়?

বজ্রপাত হলো একধরনের প্রাকৃতিক বৈদ্যুতিক নির্গমন, যা মেঘ ও মাটির মধ্যে বা দুটি মেঘের মধ্যে ঘটে। সাধারণত বজ্রপাতের সময় অনেক বেশি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চার্জ আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে। এই বিদ্যুৎচমক যখন মাটিতে আঘাত হানে, তখন তা প্রাণঘাতী হতে পারে। খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, বিশেষত যাদের শরীর বা ব্যবহার্য জিনিসপত্রে ধাতব উপাদান থাকে, তারা ঝুঁকির মুখে পড়েন।

বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বজ্রপাতের প্রকোপ আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তালগাছের সঙ্গে বজ্রপাত প্রতিরোধের সম্পর্ক

তালগাছের উচ্চতা অনেক বেশি, এবং এর কাণ্ড দীর্ঘ ও সোজা হওয়ায় এটি সহজেই বজ্রপাতের আঘাত গ্রহণ করে। অর্থাৎ, তালগাছ নিজে বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে ও তা মাটিতে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। ফলে তালগাছের আশেপাশে থাকা মানুষ ও গবাদিপশু অনেকাংশে নিরাপদ থাকে। এটি একপ্রকার প্রাকৃতিক ‘লাইটনিং কন্ডাক্টর’-এর কাজ করে।

বাঙালির লোকজ সমাজে একটি প্রচলিত কথা আছে—"তালগাছ বজ্রপাত টানে"। এই ধারণাটি নিছক কুসংস্কার নয়; এর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। খোলা জমিতে তালগাছ রোপণ করলে সেটি বজ্রপাতকে নিজের গায়ে নিয়ে মাটিতে পৌঁছে দিতে পারে, যেটি অন্যান্য গাছ বা উদ্ভিদের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়াও তালগাছের কাণ্ডে পানি কম থাকে, ফলে বজ্রপাতের সময় এটি আগুন ধরে যাওয়ার ঝুঁকি কম।

গ্রামীণ বাংলায় তালগাছের ঐতিহ্য

গ্রামীণ বাংলায় তালগাছ শুধু বজ্রপাত প্রতিরোধে নয়, বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তালগাছের ফল তাল, শাঁস ও রস খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর কাণ্ড ঘরের খুঁটি, চাটাই বা নৌকার কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আবার পাতা দিয়ে পাখা, বাঁশি, ডালা-বাটি তৈরি হয়। অর্থাৎ, তালগাছ কেবল একটি গাছ নয়, এটি একটি স্বনির্ভর জীবনযাত্রার প্রতীক।

একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের মাঠে মাঠে তালগাছ দেখা যেত। কৃষকরা নিজের জমির আইলে তালগাছ লাগাতেন। এতে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত, আবার তাল ফল বিক্রি করে সামান্য আয়ও হতো। তবে এখন শহরায়নের প্রভাবে তালগাছের সংখ্যা কমে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানিতে।

তালগাছ রোপণের জাতীয় উদ্যোগ

সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বর্তমানে তালগাছ রোপণের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করছে। অনেক জেলায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে তালবীজ রোপণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, যদি প্রতিটি গ্রামে, খোলা মাঠে, রাস্তার ধারে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চারপাশে ব্যাপক হারে তালগাছ রোপণ করা যায়, তাহলে কয়েক বছরের মধ্যেই বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি অনেকাংশে কমে আসবে।

২০১৭ সালে ফরিদপুর জেলা প্রশাসন পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন রাস্তার পাশে ও মাঠে প্রায় ৩ লাখ তালবীজ রোপণ করে। কয়েক বছরের মধ্যেই সেই গাছগুলো বৃদ্ধি পেয়ে এখন বজ্রপাত প্রতিরোধে সহায়তা করছে বলে জানা যায়। এমন সফল উদ্যোগ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেছে।

তালগাছ রোপণের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ

সুবিধাসমূহ:- বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর * পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘস্থায়ী * খাদ্য ও অর্থনৈতিক উপকারিতা * ভূমি ক্ষয়রোধে সহায়ক * পশু ও মানুষের ছায়া বিশ্রামের স্থান

চ্যালেঞ্জসমূহ:

* গাছ বড় হতে সময় লাগে (৮-১০ বছর * তালবীজ বপনের পরে পরিচর্যার অভাব * কিছু এলাকায় তালগাছ কাটার প্রবণতা * যথাযথ নীতিমালা ও নজরদারির অভাব

করণীয়

১. সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম: স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমে তালগাছের গুরুত্ব নিয়ে ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি।

২. রাষ্ট্রীয় উৎসাহ প্রদান: তালগাছ রোপণে প্রণোদনা বা পুরস্কার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

৩. স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ: ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে তালবীজ রোপণের পরিকল্পনা গ্রহণ।

৪. গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ: কোথায়, কীভাবে তালগাছ সবচেয়ে কার্যকরভাবে বজ্রপাত প্রতিরোধ করে—এ নিয়ে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ।

৫. আইনগত সহায়তা: তালগাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ।

পরিশেষে বলতে চাই, তালগাছ যেন শুধুই গ্রামীণ বাংলার নিসর্গ নয়, এটি এখন মানুষের জীবন রক্ষার প্রতীক। বজ্রপাতের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগের সহজ, প্রাকৃতিক এবং কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে তালগাছের ব্যবহার একটি যুগান্তকারী ধারণা। সময় এসেছে এই ঐতিহ্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করার। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি দেশের প্রতিটি উন্মুক্ত জমিতে তালগাছ রোপণ করা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test