E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মাতৃ ও শিশু মৃত্যু রোধে প্রশিক্ষিত ধাত্রীর দরকার

২০২৫ মে ০৪ ১৭:২১:০২
মাতৃ ও শিশু মৃত্যু রোধে প্রশিক্ষিত ধাত্রীর দরকার

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


সোমবার ৫ মে দেশে পালিত হবে বিশ্ব ধাত্রী দিবস ২০২৫। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর আজকের এই দিনে পালিত হয় দিবসটি। সন্তান প্রসবে যুগ যুগ ধরে ঘরে ঘরে যারা সেবা দিয়ে আসছে, সেই ধাত্রী বা মিডওয়াইফদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই দিবসটি পালন করা হয়। ধাত্রীদের উপযুক্ত মর্যাদা দেয়ার জন্য ১৯৮০ এর দশক থেকে আন্দোলন শুরু হয় আন্তর্জাতিকভাবে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে ৫ই মে তারিখটিকে আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রতি বছরই এই দিবসটি পালনের প্রাক্কালে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মিডওয়াইফ তৈরীর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। বুদ্ধিজীবী মহলের বক্তব্য হচ্ছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার বহুলাংশে হ্রাস করতে দক্ষ মিডওয়াইফ গড়ে তোলা দরকার। এই গুরুত্ব বিবেচনা করেই সরকারী প্রতিষ্ঠানে মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টির পাশাপাশি মিডওয়াইফ শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হচ্ছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মিডওয়াইফ।দেশে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে নিবন্ধন করা মিডওয়াইফের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন সাব সেন্টারে প্রায় ২ হাজার ৫৫৭ জন মিডওয়াইফ কাজ করছেন। তবে সেবাগ্রহীতার তুলনায় মিডওয়াইফদের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দ্রুত মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া জরুরি। গত বছর চারটি কলেজে মাত্র ২০টি করে মোট ৮০টি সিটে মিডওয়াইফরা বিএসসি-ইন-মিডওয়াইফারির সুযোগ পেয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।

বাংলার গ্রামীণ জনপদে মিডওয়াইফ বা ধাত্রী পেশা অতি প্রাচীন। অতীতে যখন চিকিৎসা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, তখন কোন প্রসূতির সন্তান প্রসবে ধাত্রীই ছিলো একমাত্র ভরসা। এরা প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছাড়াই বেশ দক্ষতার সাথেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে আসছে। দু’য়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া সন্তান প্রসবে সহযোগিতার কাজটি তারা সফলতার সঙ্গেই করছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে তাদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তাই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মিডওয়াইফদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর পেশাগত দিক থেকে হোক বা নিজের দায়িত্ববোধ থেকে হোক একজন মিডওয়াইফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সাধারণত সোজা বাংলায় মিড ওয়াইফদের ধাত্রী নামে ডাকা হয় বা সবাই এই নামে চিনে থাকে।গ্রামীণ জীবনে এখনও আঁতুড় ঘরের ব্যবস্থা আছে। আর সেই ঘরটা সাধারণ সবচেয়ে ছোটো এবং স্বাস্থ্যগতভাবে অনিরাপদ। মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সন্তান। সেই শ্রেষ্ঠ সম্পদ সন্তানের আগমন উপলক্ষে নিশ্চয় চমৎকার না হোক স্বাস্থ্যসম্মত একটা আয়োজন থাকতেই হবে। প্রবসকালীন আপদ-বিপদের জন্য পরিবারের সদস্যদের প্রস্তুত থাকতে হবে সার্বিক অর্থে। প্রয়োজনে এলাকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিতে হবে মাকে। সন্তানের স্বার্থেই মাকে সুস্থ রাখা অনিবার্য। নিছক অচল পয়সার মতো সংস্কারের মায়ায় মা ও সন্তানকে কিছুতেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া যায় না।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যায় ৪৮.৬ ভাগ নারী। এর মধ্যে ১৮ ভাগ নারী সন্তান ধারণে সক্ষম। সন্তান ধারণে সক্ষম নারীদের গর্ভাবস্থায়, প্রবসকালীন ও পরবর্তী সময়ে অনেক সমস্যাই দেখা দেয়। যার কারণে এ সময়গুলোয় নারীকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে নবজাতক। বাংলাদেশ নবজাতকের মৃত্যুর হার খুব ধীরগতিতে কমছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ১০০০ জনে ৪২ জন শিশু বিভিন্ন জটিলতায় মারা যায়। বর্তমানে সংক্রামক ব্যাধিজনিত মৃত্যুর কারণগুলো কমলেও যেসব কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়, সেই কারণগুলো এখনো কমানো যায়নি। বাংলাদেশে শতকরা ৩৩ শতাংশ শিশু পুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ শিশু বয়স অনুযায়ী লম্বা হয় না এবং ৪১ শতাংশ শিশুর বয়সের চেয়ে ওজন কম।

দেশে প্রতি বছর অন্তত ২৪ লাখ নারী ঘরেই সন্তানের জন্ম দেন কোনো আধুনিক ব্যবস্থা ছাড়াই। এভাবে সচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রবসকালীন মাতৃমৃত্যু। বড় শহরগুলোর বাইরে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে পড়ে প্রতি বছর বহু নারী প্রসবকালীন সময়ে মারা যায়। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় রক্তক্ষরণ, প্রসব-পরবর্তী জটিলতা এবং অস্বাস্থ্যকর আতুরঘরে প্রসবের কারণে ২৫ শতাংশ প্রসূতির মৃত্যু ঘটে। অদক্ষ ধাত্রীর হাতে এখনও ৮৫ শতাংশেরও বেশি প্রসব হয়; যাতে মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। বাল্যবিয়েও নিরাপদ মাতৃত্বের পথে একটি বড় বাধা। দেশে বয়ঃসন্ধিকালে গর্ভবতী হওয়ার সংখ্যা ৬০ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রত্যেক তিনজন কিশোরীর একজনই গর্ভধারণের অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব করালেই হয়তো প্রসবকালীন শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যানটা পাল্টে যেতে পারে। আর এজন্য সবার আগে প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী, যারা ঘরে ঘরে পৌঁছে প্রসবকালে মায়েদের পাশে থাকবেন, কখনো নিজেরাই প্রসব করাবেন, আবার প্রসবের সময় জটিল পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকদের কাছে পাঠানোর জন্য বাড়ির অভিভাবকদের উৎসাহিত করবেন।

গর্ভবতী নারীরা যদি গর্ভকালীন সঠিক সেবা-শুশ্রুষা না পায়, তাহলে প্রসবকালীন নানা সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মনে করেন, নারী গর্ভবতী হওয়ার পরপরই ধাত্রীর শরণাপন্ন হওয়া উচিত। পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ এবং চলাফেরা করা উচিত। তাছাড়া একটি সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ অর্থাৎ আনন্দময় পরিবেশে গর্ভবতী মাকে রাখা প্রয়োজন।

সাধারণত মিডওয়াইফ বা ধাত্রীরা মাতৃসেবা দান করে থাকেন। গর্ভাবস্থায় থেকে শুরু করে প্রসব ও নবাগত শিশুর পরিচর্যা এবং পরামর্শ প্রদান করাই হলো মিডওয়াইফের আসল কাজ।

> ক্যারিয়ারঃ মিডওয়াইফদের নির্দিষ্ট কোনো পদন্নোতি না থাকলেও অভিজ্ঞতার আলোকে তারা সুপারভাইজার পর্যন্ত হতে পারেন। তাছাড়া এই পেশায় নির্দিষ্ট বেতনের পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা বাহিরে প্রচুর ইনকাম করতে পারেন। এই পেশায় আয় রোজগারের পাশাপাশি মানুষকে সহয়তা করার যে তৃপ্তি অর্জন করা যা তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে বলতে পারি আপনি যদি মানুষের সহায়তায় নিজেকে উজাড় করে তুলে ধরতে চান এবং ভালো একটি পেশা বা পদবীতে কাজ করতে চান তাহলে মিডওয়াইফ পেশাটি হতে পারে আপনার জন্য একটি আদর্শবান পেশা।

একজন মিডওয়াইফ

পদবী: মিডওয়াইফ/ধাত্রী।শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ অনুমোদিত/স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি/বিএসসি ইন মিডওয়াইফারি ডিগ্রী নিয়ে এই পেশায় আবেদন করা যায় বা চাকরি করা যায়।

প্রতিষ্ঠান: সরকারি/বেসরকারি, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

ধরন: পার্ট টাইম/ফুল টাইম।

অভিজ্ঞতা: সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় না। তবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ১-২ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়ে থাকে।

স্কিল: নার্সিং-এ দক্ষতা, গর্ভবতী মা শিশু সেবার যাবতীয় বিষয়ে দক্ষতা, প্রসবকালীন ও শিশু বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান, স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান, ধৈর্য্য ইত্যাদি।

কাজ: সাধারণত একজন মিডওয়াইফ যেই ধরণের কাজ গুলো করে থাকেন সেই গুলো হলো-

গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভহিত করা। গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য জনিত বা অন্যান্য কোনো বিপদজনক উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।সন্তান প্রসবের পূর্বে গর্ভবতী নারীকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়া ও ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করা। গর্ভবর্তী নারী সন্তান প্রসবের পর তাকে প্রয়োজনীয় সেবাদান করা ও নবাগত শিশুর পরিচর্যা করা।গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারকে নব্য মা ও নব্য শিশুর যত্নে করণীয় সম্পর্কে বুঝিয়ে দেয়া।উল্লেখিত বিষয় গুলো ছাড়াও মিডওয়াইফ গর্ভবতী নারী, নব্য মা ও নব্য শিশুর প্রয়োজনে পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও আরো নানা ধরণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

পরিশেষে বলতে চাই, নার্সিং স্বাস্থ্যসেবার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা বিশ্বে নার্সদের অত্যাধিক চাহিদা থাকা সত্বেও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাংলাদেশে দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরী করা যাচ্ছে না। আর মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দক্ষ ও পেশাদার মিডওয়াইফরা মা ও নবজাতকের মৃত্যু রোধের পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সেবায়ও ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালনে জবাবদিহিতার জন্যও প্রস্তুত থাকা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা একজন দক্ষ মিডওয়াইফ বা ধাত্রীর সেই জ্ঞান থাকাটা জরুরী যে, কখন একজন মাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যুগ যুগ ধরে যে ধাত্রীরা মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে, সেই ধাত্রী পেশাই এখন স্বীকৃতি পেয়েছে। এদেরকে দেয়া হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এই মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব সরকারের যতোটুকু, তার চেয়ে বেশী এই পেশায় নিয়োজিতদের। আর এক সময় গ্রামে-গঞ্জে এক শ্রেণির নারীরা হাজার হাজার গর্ভবতীর নরমাল ডেলিভারি করাতো। আর সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার প্রাণরক্ষাকারী পদক্ষেপ হলেও দেশে অপ্রয়োজনীভাবে এর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যত গর্ভবর্তী নারী নবজাতক শিশু প্রসব করেন তার শতকরা ২৩ ভাগ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ কর্তৃক বেঁধে দেয়া হারের প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে শতকরা ৩৮ ভাগ ও বেসরকারি পর্যায়ে শতকরা ৮০ ভাগ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হয়, যা খুবই উদ্বেগজনক। আর প্রসবকালীন জটিলতা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অদক্ষতার কারণে নারীদের ফিস্টুলাসহ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার হার বেড়ে যাচ্ছে; যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ দিবসে দেশের ও বিশ্বের সকল মিডওয়াইফ/ধাত্রীদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সফল হোক আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ/ধাত্রী দিবস।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test