E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা: পর্ব- ০৫

জহুরুল হক হলের স্মৃতি কথা

২০২৫ মে ১০ ১৭:৪৮:৫৪
জহুরুল হক হলের স্মৃতি কথা

রহিম আব্দুর রহিম


জামালপুর জেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে জন্ম, কর্মসূত্রে বাসিন্দা পঞ্চগড়ে। প্রাইমারি জীবন থেকেই স্বপ্ন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার। পরিবার থেকে  আর্থিক যোগান দেবার ক্ষমতা একেবারেই ছিলো না। চান্স পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৮-১৯৮৯ সেশনের আমি বাংলা বিভাগের ছাত্র, এটাস্ট্র জহুরুল হক হল। গ্রাম থেকে এসেছি শহরে, তাও আবার ছোট শহর নয়, ঢাকার শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি, একথা এলাকার কেউ বিশ্বাস করতেই চায় নি। কারণ, সারারাত নাটক গান- বাজনা, এর ফাঁক ফোঁকরে পড়ালেখা করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয় কি করে? আমার আনন্দঘণ শৈশব, প্রফুল্ল মানসিকতার কারণে অভাব কাছে ভিড়তে পারে নি।সাংবাদিকতার হাতে খঁড়ি সেই ১৯৮৬ সালে। কলেজ অধ্যয়নকালে জাতীয় ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হবার পর লেখালেখিও বন্ধ। 

বাংলা বিভাগের শ্রদ্বেয় শিক্ষক সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারকে আমার অভাব অনটনের কথা জানালাম, জানতে চাইলেন যোগ্যতা, বললাম, কলেজে অধ্যয়নকালে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেছি। একথা শোনার পর স্যার একটা চিরকুট লেখলেন তৎকালীন সাপ্তাহিক আগামী, তারকালোক ও শিশু তারকালোক-এর সম্পাদক আরেফিন সিদ্দিকী বাদল ভাইকে। ওই দিনই চিরকুট নিয়ে নীলক্ষেতে অবস্থিত পত্রিকা অফিসে হাজির হলাম। পত্র তুলে দিলাম বাদল ভাইকে। লেখতে হবে ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়ে। লেখলাম, প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমার নাম ছাঁপা হয়েছে, 'রহিম আব্দুর রহিম।' শুরু হলো সাংবাদিকতা, ওই সময়কার বাঘা-বাঘা ছাত্র নেতাদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে, অস্ত্রধারীদের খবরা-খবর কম নয়, সেই থেকে দৈনিক বাংলা বাজার, বাংলার বাণী, সাপ্তাহিক চিত্র বাংলা, সাপ্তাহিক দিনকাল, সাপ্তাহিক রাজপথ, সাপ্তাহিক ঢাকায় লেখালেখি। আমি ক্যাম্পাসে সাহসী প্রতিবেদক হিসেবে পরিচিত। সেই সুবাদে তৎকালীন ছাত্র নেতা আমানুল্লাহ আমান, খায়রুল কবীর খোকন, অসীম কুমার উকিল, ইলিয়াস আলী, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, অভিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের সাক্ষাৎ ভিত্তিক প্রতিবেদন করেছি বহুবার। বিএনপি ক্ষমতা আমলে আইনমন্ত্রী মীর্জা গোলাম হাফিজ,সাবেক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারসহ ওইসময়কার পজিশন -অপজিশন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাক্ষাৎকার প্রতিবেদনও করেছি।

যাই হোক, একদিন জহুরুল হক হলের নেতৃত্ব থাকা প্রয়াত শহীদুল ইসলাম চুন্নু ভাইকে আমার পরিচয় দিলাম, ৩১৭/১ নম্বর কক্ষে উঠলাম। লেখালেখি করে যা পাই, তা দিয়ে ডাইনিং ক্যান্টিনের খাবার হয় না। কক্ষেই হিটার ফিট করে রান্না-বান্না। সাংবাদিকতা করি বলে হলের নেতারা ভাল বাসেন। মাঝে মধ্যে রান্না হতো খিঁচুড়ি। হলের নেতারাও তাতে শরীক হতেন। এই হলের ওই সময়ের তুখোড় ও প্রভাবশালী ছাত্র নেতা ৮৩-৮৪ শিক্ষা বর্ষের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ও হল সংসদের সাবেক জিএস মাসুম আহমেদ ভাই, তাঁর সাথে সম্পর্ক গভীর, তাঁর গ্রুপ রাজনীতির সাথে জড়িত হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ১৯৮৫-১৯৮৬ শিক্ষাবর্ষের মেধাবী ছাত্র মাহফুজুর রহমান খান রিপন ভাই; যিনি বর্তমানে আইআরও (খুলনা বিভাগীয়) রেজিস্ট্রার। রিপন ভাই, ৩০২ নম্বর কক্ষে থাকতেন।কক্ষ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করলাম প্রভোস্ট বরাবর, ৩০৭ নম্বর কক্ষ পেলাম। হলের মন্ত্রীপাড়া বলে খ্যাত এই ব্লকটি রাজনৈতিক বিবেচনায় বরাদ্দ হতো, আমিই একমাত্র অরাজনৈতিক ছাত্র। কারও কোন আপত্তি না থাকায় ৩০৭ নম্বর কক্ষে থেকেই লেখাপড়া শেষ করি। পরে এই কক্ষে কিছুদিন অবস্থান করে ১৯৯২-১৯৯৩ শিক্ষাবর্ষের দর্শন বিভাগের মোঃ আসাদুজ্জামান আসাদ। সে বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তর ময়মনসিংহে সহকারি পরিচালক হিসেবে কর্মরত। আসাদ আমার নিকট আত্মীয় এবং স্কুল জীবনের একই স্কুলের জুনিয়র।

আমরা যখন হলে ছিলাম, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল ছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র, অস্ত্রগুলির ভান্ডারখানা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার। ব্লকের প্রতিটি রুমে থাকতো অস্ত্রগুলি। আমি সাংবাদিক হওয়ায় আমার রুমে কেউ অস্ত্রগুলি রাখেনি, তবে একবার হঠাৎ দুপুর বেলায় পুলিশ তল্লাশি,সন্ত্রাসীরা ছুটোছুটি করছে,আমার কক্ষের সামনে ফেলে যায় হলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এসএল আরটি। পুলিশ তা জব্দ করে নিয়ে যায়। ঐদিন আর একটি রুম থেকে উদ্ধার অস্ত্র এবং গুলি। মামলা হয় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে। মামলার সাক্ষী করা হয় আমাকে। যে মামলায় (২০১৬-১৭ দিকে) স্বাক্ষী দিতে আমাকে যেতে হয়েছে ঢাকা জজকোর্টে। যে কথা বলছিলাম, হলের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম বলে হলের প্রশাসনিক ব্যক্তিরাও পছন্দ করতেন। গোলাগুলি, মারধাঙ্গা পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যেও থাকতাম হাসিখুশি। যা ছিলো পরিচিত জনদের মধ্যে স্বীকৃত।

১৯২০ সালের ২৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণে স্থাপিত বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাতি অর্জন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ইকবাল হল ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। পরে এই হলের নামকরণ হয় শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ প্রথম স্বাধীনতার পতাকা এই হলেই উত্তোলন করা হয়। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০'র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২৪’র কোটাবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিমুহূর্ত এই হল থেকেই সৃষ্ট।

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের অ্যালামাইন এসোশিয়েশন পূর্ণগঠনের লক্ষ্যে এক সাধারণ সভা ৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের ডুয়া অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন ১৯৮২-৮৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী একে এম মাসুদুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব), উপস্থিত ছিলেন ৮১-৮২ শিক্ষা বর্ষের ও ডাকসুর সাবেক সদস্য জনাব খোরশেদ আলম, ১৯৮৪-৮৫ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক জনাব এ. কে. এম শহীদুর রহমান লিটু, ৮৪-৮৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র, বর্তমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ডঃ লুৎফর রহমান, ৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষ ও হল সংসদের সাবেক জিএস মাসুম আহমেদ, জয়েন্ট ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি'র এমডি এবং সিইও মোঃহুমায়ুন কবীর। ১৯৮৩-১৯৮৪ শিক্ষাবর্ষের আফতাব আহমেদ, ৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের ও ৯০ এর দশকের ক্যাম্পাসের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা লুৎফর রহমান, মোঃ মাহফুজুর রহমান খান রিপন, বাংলাদেশ বিমান এর এমডি ও যুগ্মসচিব জনাব আব্দুর রফিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ নাসির আহমেদ, আমার বন্ধু আমিনুল ইসলাম ও পুলিশ কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম।

২২তম বিসিএস কর্মকর্তা মোঃ আবুয়াল কায়সার ও আব্দুর রহমান সাজ্জাদ এর সঞ্চালনায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ১৯৯১-১৯৯২বর্ষের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বর্তমান অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত আবুল কালাম আজাদ, ১৯৯২-৯৩ বর্ষের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী বর্তমান সমাজসেবা অধিদপ্তরের ময়মনসিংহে কর্মরত সহকারি পরিচালক আসাদুজ্জামান আসাদসহ প্রায় দুইশতাধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থী। আলোচনা শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ডঃ লুৎফর রহমানকে আহবায়ক, লুৎফর রহমান (বিএনপি'র তুখোড় নেতা)কে ষুগ্ম আহবায়ক এবং ব্যারিস্টার শাহীন আহমেদকে সদস্য সচিব করে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমি এই সভায় শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল অ্যালামাইন এসোসিয়েশনকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি গঠনতন্ত্র প্রনয়ণ ও একটি ডিরেকটরি প্রকাশ করার প্রস্তাব রাখি, যে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতি ক্রমে গৃহীত হয়। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক : কলামিস্ট, নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test