জাদুঘর কেবল প্রদর্শনী নয়, ইতিহাসের জীবন্ত পাঠশালা
ওয়াজেদুর রহমান কনক
প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চা কোনো জাতির সাংস্কৃতিক চেতনা ও পরিচয়ের ভিত্তি। এই চেতনার ধারক হিসেবে জাদুঘরগুলো যুগ যুগ ধরে সমাজকে তার শিকড় চিনতে সহায়তা করে এসেছে। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসেও বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে জাদুঘর ব্যবস্থাপনা নানাবিধ সংকটে নিমজ্জিত। স্থান সংকুলান, জনবল ও অর্থসংকট, প্রযুক্তির অভ্যন্তরীণ অনুপস্থিতি, সংরক্ষণ নীতির দুর্বলতা, এবং দ্বায়িত্বশীলদের অবহেলার কারণে বহু মূল্যবান নিদর্শন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জাতির ঐতিহাসিক স্মারক ও ঐতিহ্য।
এই প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ১৮ মে পালিত আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস (International Museum Day) শুধু একটি প্রতীকী দিবস নয়; বরং এটি জাদুঘরের গুরুত্ব, সামাজিক ভূমিকা এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার একটি বৈশ্বিক আহ্বান। ১৯৭৭ সালে International Council of Museums (ICOM) কর্তৃক প্রবর্তিত এই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো জাদুঘরকে শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনীর স্থান নয়, বরং শিক্ষা, গবেষণা ও সামাজিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে তুলে ধরা।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী জাদুঘর এই সংকটের একটি জীবন্ত উদাহরণ। প্রাচীন ও দুর্লভ নিদর্শনের সম্ভারে সমৃদ্ধ এই প্রতিষ্ঠানটি আজ অচর্চা ও অবহেলায় বিলীন হওয়ার পথে। এ পরিস্থিতি শুধু একটি জেলার সমস্যা নয়, বরং তা জাতীয় সাংস্কৃতিক দূরদর্শিতার অভাব ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের প্রতি অসচেতন মনোভাবের প্রতিফলন।
নীলফামারী জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মজিবর রহমান নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন গোটা জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার নিদর্শন সমূহ। নীলফামারী জাদুঘর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, যা এই অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ জাদুঘরটি জেলার ডিসি অফিসের পুরাতন ভবনে অবস্থিত। যদিও ১৯৫৮ সালেই এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, ১৯৮৩ সালে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।
২০০০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবিএম কামরুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন। জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত রয়েছে হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন ও বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্মারক। এখানে দেখা মেলে ছয় হাজার বছরের প্রাচীন মরমর পাথর, শত বছরের পুরনো কষ্টিপাথরের মূর্তি, তালপাতায় লেখা প্রাচীন রামায়ণ ও মহাভারত, হারিয়ে যাওয়া পুঁথি, মোগল আমলের বিশাল আকৃতির তালা, আদিম যুগের ব্যবহৃত দাঁড়িপাল্লা, পুরনো নৌকা, রূপার হুক্কা, হাতির দাঁতের লাঠি, কেরোসিন চালিত ফ্যানসহ নানা রকম দুর্লভ জিনিসপত্র।
বাংলার লোকজ সংস্কৃতির প্রতিফলনও এখানে পরিলক্ষিত হয়—যেমন নকশিকাঁথা, মাটির পুতুল, কাঠের তৈরি খেলনা, বাদ্যযন্ত্র, প্রাচীন আমলের পাণ্ডুলিপি এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়কার কিছু দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরটি বর্তমানে নানা সমস্যার সম্মুখীন। জায়গার সংকুলান, জনবল সংকট ও আর্থিক দুরবস্থার কারণে এটি চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়েছে। বহু মূল্যবান নিদর্শন অবহেলার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নীলফামারী জাদুঘর কেবল একটি জাদুঘর নয়, এটি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চেতনার এক জীবন্ত দলিল। এর প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মজিবর রহমান নিজ হাতে সংগ্রহ করেছেন বহু নিদর্শন, যা এখানকার ইতিহাস সংরক্ষণে তাঁর আত্মনিবেদিত প্রচেষ্টার প্রমাণ বহন করে। তাই এই জাদুঘরের যথাযথ সংরক্ষণ এবং আধুনিকায়নের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলের উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি। নীলফামারী জাদুঘর একসময়ে ছিল উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণের একটি গর্বের কেন্দ্র, অথচ আজ তা নিঃশব্দে বিলীন হওয়ার মুখে। স্থান সংকুলান, জনবল ঘাটতি, বাজেট অভাব, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি, উদাসীনতার কারণে এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
শত শত বছর পুরোনো দুর্লভ নিদর্শন ধূলি-মলিন অবস্থায় পড়ে রয়েছে, সংরক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহু মূল্যবান সম্পদ। অথচ এই জাদুঘরটি একসময় স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও লোকজ ঐতিহ্যের এক অনন্য সংগ্রহশালা হিসেবে খ্যাত ছিল। সরকারি তত্ত্বাবধান ও আধুনিক পরিকল্পনার অভাবে এ জাদুঘরের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নীলফামারী জাদুঘর রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন, নইলে হারিয়ে যাবে একটি জেলার নয়, বরং একটি অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাসের নিদর্শন।
এই চিত্র শুধু নীলফামারীর নয়—বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এমন জাদুঘরগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব জাদুঘরই হতে পারত স্থানীয় ইতিহাসচর্চার কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণার অংশ এবং সাংস্কৃতিক ট্যুরিজমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বিশ্বের অনেক দেশেই জাদুঘরকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরা হচ্ছে। ভার্চুয়াল ট্যুর, কিউআর কোড ভিত্তিক ব্যাখ্যা, ইন্টারেক্টিভ ডিসপ্লে, অনলাইন এক্সিবিশনের মাধ্যমে মানুষকে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও জাতীয় জাদুঘর কিছু ডিজিটাল উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু আঞ্চলিক ও ব্যক্তি-নির্ভর জাদুঘরগুলো এখনো অবহেলার অন্ধকারে।
তবে সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। প্রথমত, সরকার এসব স্থানীয় জাদুঘরের জন্য একটি বিশেষ সহায়তা তহবিল গঠন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, জেলাভিত্তিক জাদুঘর সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের আওতায় আলাদা জনবল ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা দরকার। তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এই জাদুঘরগুলোকে শিক্ষার অংশে রূপান্তর করা যেতে পারে। পাশাপাশি, তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে জাদুঘরকে ‘কমিউনিটি মিউজিয়াম’ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
এছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক দাতাদের সম্পৃক্ত করে একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, স্থানীয় মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে যে—এই জাদুঘর কেবল অতীত দেখানোর নয়, বরং নিজেদের পরিচয় জানানোর মাধ্যম।
একটি জাতি যদি তার ইতিহাস সংরক্ষণ করতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতেও সে দাঁড়াতে পারে না। নীলফামারী জাদুঘরের এই সংকট আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়—যদি এখনই আমরা ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগী না হই, তবে অদূর ভবিষ্যতে এই ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় বা স্মৃতিকাতর গল্পে সীমাবদ্ধ থাকবে। শুধু জাতীয় নয়, স্থানীয় ইতিহাসও আমাদের পরিচয়ের অংশ। এবং সেই ইতিহাস রক্ষা করাই হোক আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
পাঠকের মতামত:
- ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৪ জন
- নিজেকে বাঁচাতে মাকে দিয়ে বাদির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা সন্ধিগ্ধ আসামী রফিকুলের!
- জেলা প্রশাসকের বাসভবনে হামলার ঘটনায় ১০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
- আরবি লেখা শেখার ছলে ঘরে নিয়ে শিশুশিক্ষার্থীকে ধর্ষণ, ধর্ষক গ্রেফতার
- সাত উপাচার্যের অংশগ্রহণে গোপালগঞ্জ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ম ব্যাচের 'শিক্ষা সমাপনী
- হৃদরোগে আক্রান্ত জামায়াত আমির, বাইপাস সার্জারির পরামর্শ
- ‘৫ আগস্ট ঘিরে কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা নেই’
- ‘সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে ফ্যাসিস্ট মাথাচাড়া দিতে পারে’
- শ্রীনগরে অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে চলছে স্বাস্থ্য সেবা
- হাসিনাকে দেশে ফেরাতে আ.লীগের নতুন পরিকল্পনা
- ‘গাজীপুরে আসন বাড়বে, কমবে বাগেরহাটে’
- ডেঙ্গুতে আরও ২ মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৮৬ জন
- ১০২ এসিল্যান্ড প্রত্যাহার
- জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি ঐক্য পরিষদের
- ‘তিন মাসে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন হয়েছে, এক বছরেও না হওয়ার কারণ দেখছিনা’
- পাংশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ
- স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে শাহীন গ্রেপ্তার
- জামালপুরে দুই টিকিট কালোবাজারি আটক
- গোপালগঞ্জে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
- সোনাতলায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
- ফুলপুরে পরিষ্কার পরিছন্নতার বিশেষ অভিযান
- স্বাধীনতা ও জাতিসত্তা রক্ষার লড়াইয়ে চাই জাতীয় ঐক্য
- নিউ ইয়র্কে বন্দুক হামলার সময় কর্মরত ছিলেন না নিহত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল
- সেরা দূরপাল্লার এয়ারলাইনের স্বীকৃতি পেলো এমিরেটস
- ডিসকভারির সাথে পার্টনারশিপে উদ্বোধন হলো অপো রেনো ১৪ সিরিজ ৫জি স্মার্টফোন
- কমলনগরে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আটক
- হিমেল হাওয়ায় কাবু কুড়িগ্রামের মানুষ
- ‘কোন মানুষ অর্থের কাছে চিকিৎসায় হেরে যাবে না, সবাই বাঁচবে’
- ঝিনাইদহে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী নিহতের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি
- রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল ৩ মোটরসাইকেল আরোহীর
- প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি, বিএনপি নেতা চাঁদের নামে মামলা
- মা
- প্রজন্মের কাছে এক মুক্তিযোদ্ধার খোলা চিঠি
- পারিবো না
- ঝিনাইদহে বজ্রপাতে মৃত দুই কৃষক পরিবারকে তারেক রহমানের মানবিক সহায়তা প্রদান
- অতিরিক্ত ঠান্ডায় ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়েছে শিশু রোগীর সংখ্যা
- লক্ষ্মীপুরে গুলিবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু
- রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করছে জান্তা
- লক্ষ্মীপুরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন
- নৌকার পক্ষে সমর্থন জানানেল এডভোকেট আব্দুল মতিন
- লক্ষ্মীপুরে দোকান ঘর বিক্রির নামে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা
- মহুয়া বনে
- রুমা-থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি: ১৭ নারীসহ ৫২ জন রিমান্ডে
- বিজনেস সামিটের পর্দা নামছে আজ
- সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রতিবাদে শেরপুরে প্রতিবাদ সমাবেশ