ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বৈচিত্র্য সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ওয়াজেদুর রহমান কনক
বাংলাদেশ নিজেই একটি বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উদাহরণ। এখানে শত শত বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এমন একটি দেশে "বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ দিবস" (২১ মে) কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়—বরং আত্মপর্যালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। আমাদের সমাজের গভীরে লুকিয়ে আছে একাধিক সাংস্কৃতিক স্তর, যেগুলো অনেক সময়ই মূলধারার আলোচনার বাইরে থেকে যায়। অথচ এই বৈচিত্র্যই আমাদের পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি।
বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কথা বলা হলেও বেসরকারি ও গবেষণাভিত্তিক তথ্যে সংখ্যাটি ৭৫-এর বেশি। UNDP ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য মতে, মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৮ শতাংশ মানুষ এই গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্ভুক্ত, যা সংখ্যায় প্রায় ২০–২৫ লাখ। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরি, সাঁওতাল, গারো, খাসি, রাখাইনসহ আরও অনেক গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্মীয় রীতিনীতি, পোশাক, উৎসব ও আচার। ‘Ethnologue’-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৪টি জীবিত ভাষা রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ১২টি মারাত্মক বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। ইউনেস্কোর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই ভাষাগুলোর জন্য ডিজিটাল সংরক্ষণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য শুধু জাতিগোষ্ঠী বা ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ধর্মীয় বৈচিত্র্য, আঞ্চলিক জীবনধারা, লোকসংস্কৃতি, শিল্পকলা, স্থাপত্য—সব মিলিয়ে একটি বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে। যেমন রাজশাহীর নকশিকাঁথা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা নৃত্য, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাউল-লালন ধারা কিংবা কক্সবাজারে রাখাইনদের ধর্মীয় উৎসব—সবকিছু একসাথে আমাদের জাতিসত্ত্বাকে সমৃদ্ধ করছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মতে, দেশে প্রায় ৪৫০টির বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো বহু ধর্ম ও জাতির সহাবস্থানের ইতিহাস বহন করে।
এই বাস্তবতা যখন আমরা উপলব্ধি করি, তখন ২১ মে-এর মতো একটি দিবস নতুন অর্থ পায়। ইউনেস্কো ২০০১ সালে ‘Universal Declaration on Cultural Diversity’ ঘোষণা করে এবং ২০০২ সাল থেকে ২১ মে-কে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘World Day for Cultural Diversity for Dialogue and Development’ হিসেবে পালন শুরু করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সংলাপ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বিশ্বায়নের প্রভাবে। একটি ভাষা বা সংস্কৃতি যখন বিশ্বমঞ্চে আধিপত্য বিস্তার করে, তখন অনেক ক্ষুদ্র ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এক সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বে প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের মোট ভাষার ৪০ শতাংশই ঝুঁকির মুখে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি ভিত্তিক জীবনধারা—সব মিলিয়ে একটি একরৈখিক সাংস্কৃতিক প্রবাহ তৈরি করছে, যেখানে দুর্বল সংস্কৃতি গুলো আরও বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
তবে ভালো খবর হলো, বিশ্বজুড়ে অনেক দেশই এখন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের জন্য নীতি গ্রহণ করছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, ভারতসহ অনেক দেশে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। UNESCO-এর ‘Cultural Diversity Convention’-এ স্বাক্ষরকারী দেশগুলো প্রতিবছর তাদের জাতীয় প্রতিবেদন জমা দেয়—সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি, সংরক্ষণ ও প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর বিষয়ে।
বাংলাদেশকেও এই বৈশ্বিক বাস্তবতায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে স্থান দিতে হবে। স্থানীয় সংস্কৃতির আর্কাইভ, ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন, এবং মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি করে তা শিক্ষার অংশ করতে হবে। যেমন—চাকমা ভাষার ছড়া-কবিতা, গারোদের লোকগাথা, সাঁওতালদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের দলিল ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ ও প্রচার করা যেতে পারে।
একইসাথে মিডিয়া, থিয়েটার, সংগীত, সিনেমা ও সাহিত্যে এই বৈচিত্র্যের উপস্থাপন জরুরি। কারণ, এই মাধ্যমগুলোই জনমানসে পরিবর্তন আনার প্রধান শক্তি। যেমন ভারতের জনপ্রিয় সিনেমা বা কানাডার আদিবাসী-ভিত্তিক চিত্রকলায় যেভাবে সংবেদনশীলভাবে বৈচিত্র্য তুলে ধরা হয়, বাংলাদেশেও এমন চর্চা বাড়ানো দরকার।
২১ মে তাই কেবল একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি জাতীয় মূল্যবোধে পরিণত হওয়া উচিত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মানে বিভক্তি নয়—বরং এটি সহাবস্থান, শ্রদ্ধা ও মানবিক উন্নয়নের ভিত্তি। আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি মানবিক, মর্যাদাবান ও বহুবর্ণ সমাজে বসবাসের সুযোগ পাবে।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কোনো জাতির দুর্বলতা নয়, বরং এটি তার অন্তর্নিহিত শক্তি। বাংলাদেশ এমন এক সমাজ যেখানে বিভিন্ন ভাষা, বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও জীবনদর্শন সহাবস্থান করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই বৈচিত্র্য যদি নীতিগতভাবে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়, তবে তা জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সম্প্রীতির ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এসব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করি অথবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হই। তাই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক নীতিমালায় স্পষ্টভাবে "বৈচিত্র্য সংরক্ষণ" কে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিশুদের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি জেলার নিজস্ব লোকসংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাস নিয়ে আঞ্চলিক গবেষণা, প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, গণমাধ্যমে এবং বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বেতারে সপ্তাহিক বা মাসিক অনুষ্ঠানমালায় সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, ভাষা ও সংস্কৃতির ডিজিটাল সংরক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি—যাতে দেশের প্রতিটি ভাষার জন্য একটি অনলাইন আর্কাইভ গড়ে তোলা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের মানসিকতাতেই পরিবর্তন আনতে হবে। বৈচিত্র্যকে ভয় নয়, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকে দেখতে হবে। সংবিধানের আলোকে "সবার জন্য সমান মর্যাদা" এই নীতিকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই ২১ মে কেবল একটি আন্তর্জাতিক দিবস নয়—বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয় চেতনার প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
পাঠকের মতামত:
- ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৪ জন
- নিজেকে বাঁচাতে মাকে দিয়ে বাদির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা সন্ধিগ্ধ আসামী রফিকুলের!
- জেলা প্রশাসকের বাসভবনে হামলার ঘটনায় ১০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
- আরবি লেখা শেখার ছলে ঘরে নিয়ে শিশুশিক্ষার্থীকে ধর্ষণ, ধর্ষক গ্রেফতার
- সাত উপাচার্যের অংশগ্রহণে গোপালগঞ্জ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ম ব্যাচের 'শিক্ষা সমাপনী
- হৃদরোগে আক্রান্ত জামায়াত আমির, বাইপাস সার্জারির পরামর্শ
- ‘৫ আগস্ট ঘিরে কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা নেই’
- ‘সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে ফ্যাসিস্ট মাথাচাড়া দিতে পারে’
- শ্রীনগরে অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে চলছে স্বাস্থ্য সেবা
- হাসিনাকে দেশে ফেরাতে আ.লীগের নতুন পরিকল্পনা
- ‘গাজীপুরে আসন বাড়বে, কমবে বাগেরহাটে’
- ডেঙ্গুতে আরও ২ মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৮৬ জন
- ১০২ এসিল্যান্ড প্রত্যাহার
- জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি ঐক্য পরিষদের
- ‘তিন মাসে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন হয়েছে, এক বছরেও না হওয়ার কারণ দেখছিনা’
- পাংশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ
- স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে শাহীন গ্রেপ্তার
- জামালপুরে দুই টিকিট কালোবাজারি আটক
- গোপালগঞ্জে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
- সোনাতলায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
- ফুলপুরে পরিষ্কার পরিছন্নতার বিশেষ অভিযান
- স্বাধীনতা ও জাতিসত্তা রক্ষার লড়াইয়ে চাই জাতীয় ঐক্য
- নিউ ইয়র্কে বন্দুক হামলার সময় কর্মরত ছিলেন না নিহত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল
- সেরা দূরপাল্লার এয়ারলাইনের স্বীকৃতি পেলো এমিরেটস
- ডিসকভারির সাথে পার্টনারশিপে উদ্বোধন হলো অপো রেনো ১৪ সিরিজ ৫জি স্মার্টফোন
- কমলনগরে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আটক
- হিমেল হাওয়ায় কাবু কুড়িগ্রামের মানুষ
- ‘কোন মানুষ অর্থের কাছে চিকিৎসায় হেরে যাবে না, সবাই বাঁচবে’
- ঝিনাইদহে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী নিহতের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি
- রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল ৩ মোটরসাইকেল আরোহীর
- প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি, বিএনপি নেতা চাঁদের নামে মামলা
- মা
- প্রজন্মের কাছে এক মুক্তিযোদ্ধার খোলা চিঠি
- পারিবো না
- ঝিনাইদহে বজ্রপাতে মৃত দুই কৃষক পরিবারকে তারেক রহমানের মানবিক সহায়তা প্রদান
- অতিরিক্ত ঠান্ডায় ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়েছে শিশু রোগীর সংখ্যা
- লক্ষ্মীপুরে গুলিবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু
- রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করছে জান্তা
- লক্ষ্মীপুরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন
- নৌকার পক্ষে সমর্থন জানানেল এডভোকেট আব্দুল মতিন
- লক্ষ্মীপুরে দোকান ঘর বিক্রির নামে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা
- মহুয়া বনে
- রুমা-থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি: ১৭ নারীসহ ৫২ জন রিমান্ডে
- বিজনেস সামিটের পর্দা নামছে আজ
- সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রতিবাদে শেরপুরে প্রতিবাদ সমাবেশ