E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নজরুল জয়ন্তী: কবির পূর্ণ-অভিনন্দন

২০২৫ মে ২৪ ১৭:৩৯:০০
নজরুল জয়ন্তী: কবির পূর্ণ-অভিনন্দন

রহিম আব্দুর রহিম


বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার কবি নজরুল। যাঁর কাব্য, প্রবন্ধ সুর ও সঙ্গীতে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে জাগরণ, বিদ্রোহ, মানবতা, প্রেম। অসাম্প্ররদায়িক চেতনার দেবতুল্য  কবি  ধর্ম-বর্ণে মানুষে মানুষে বিবাদ-বিসংবাদে উচ্চকিত করেছেন তাঁর সম্প্রীতির মহাবাণী, 'এসো ভাই হিন্দু! এসো মুসলমান! এসো! এসো ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সর্বগণ্ডী কাটাইয়া সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা সর্বস্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না।' 

কবি নজরুল ধর্মকে নিয়ে অতিশয়োক্তি করেন নি। ধর্মের চেয়ে পরাধীনতার গ্লানিকে দেখেছেন অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে। যে কারণে 'আমার ধর্ম' তিনি পরাধীনতার গ্লানিকে নিয়ে আক্ষেপ ভরে লেখেছেন-'আমার আবার ধর্ম কি? যার ঘরে বসে কথা কইবার অধিকার নেই, দুপুর রাতে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায়, অত্যাচারকে চোখ রাঙাবার যার শক্তি নেই, তার আবার ধর্ম কি? যাকে নিজের ঘরে পরে এসে অবহেলায় পশুর মত মেরে ফেলতে পারে, যার ভাই বোন বাপ মাকে মেরে ফেললেও বাক্যস্ফুট করবার আশা নাই, তার আবার ধর্ম কি? দু'বেলা দুটি খাবার জন্যই যার বাঁচা, একটু আরাম কাল কাটিয়ে দেবার জন্যেই যার থাকা, তার আবার ধর্ম কি?'

কবি শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি বারবার হয়ে উঠেছেন দুরন্ত দুর্বার, গেয়ে উঠেছেন, 'আমি দুর্বার/আমি ভেঙে করি চুরমার! /আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল... ' । আজীবন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কবি নজরুল কখনও কোন অন্যায়, মিথ্যা, কুৎসিত, কদাচারের কাছে মাথা নোয়ায় নি। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ ঘটেছে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত, সংস্কৃতিকে তিনি করেছেন সমৃদ্ধ। যার শব্দমালায় প্রকাশ হয়েছে প্রেম-প্রকৃতি ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যবোধ। একইভাবে তাঁর রচনায় বিদ্রোহী চেতনার অসামান্য রূপায়ণ ঘটেছে। জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক কবি নজরুল সর্বদায় অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং শোষণের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছেন। কবির শিকল ভাঙ্গার গানই ঘুমিয়ে পড়া বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। তাঁর লেখনী বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে উপমহাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। সংগ্রাম করে প্রগতির পথে এগিয়ে চলার সাহস যুগিয়েছে এই কবির শত সহস্র গান, কবিতা।

কবি কাজী নজরুল ১৯২২ সালে তাঁর ভাঙার গান কাব্যে 'পূর্ণ-অভিনন্দন' কবিতায়, জয় বাংলা' শব্দ যুগল ব্যবহার করেন। সময় এবং কালের প্রয়োজনে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে কবির এই সেই শব্দ যুগলই মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী স্লোগান 'জয় বাংলা।' শৌর্য-বীর্য ও স্বাধীনতা -সার্বভৌমত্বের মন্ত্রে উজ্জীবিত কবির গান 'চল চল চল' আমাদের গৌরবের প্রতীক সমর সৈনিকদের রণসঙ্গীত। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত কবি নজরুলের সাথে ১৯১৩-১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পরিচয় ঘটে তৎকালীন পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে। এই ইন্সপেক্টরের স্নেহ মমতায় ময়মনসিংহ জেলার কাজীর সিমলা ও দরিরামপুরে আগমন ঘটে কবি'র। এটাই বাংলাদেশে তাঁর প্রথম পদার্পণ।

তারুণ্যের প্রতীক কবি নজরুল ছিলেন তরুণ সমাজের অনুপ্রেরণার অনুসঙ্গ। কবির বিদ্রোহী গান, যুগ-যুগান্তরে, কাল-কালান্তরে উচ্চারিত হয়েছে সংগ্রামে, মিছিল কিংবা প্রতিবাদে। 'কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট, রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী..' এই কালজয়ী গানই প্রতিবাদী জনতার উদ্দীপনার স্বীকৃতি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি নজরুল সর্বময় বৈষমহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এবং জাতিকে দেখাতেন। কালে কালে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহী গান, কবিতা নিয়ে পথে নেমেছেন আপামর ছাত্র-জনতা, ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে উঠে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়। এ প্রসঙ্গে 'সাম্যবাদী কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, গাহি সাম্যের গান-যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু -বৌদ্ধ -মুসলিম -ক্রীশ্চান। একইভাবে তিনি মানুষ কবিতায় লেখেছেন, 'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নহে/নহে কিছু মহীয়ান।'

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test