E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নারী ও সভ্যতার ইতিহাস: প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন

২০২৫ মে ২৭ ১৭:৩৪:৫৯
নারী ও সভ্যতার ইতিহাস: প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন

ওয়াজেদুর রহমান কনক


নারী—সভ্যতার অগ্রগতির এক নীরব স্থপতি। ইতিহাসের প্রাচীনতম স্তর থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নারী ছিলেন মানব সমাজ গঠনের অন্তরালে কাজ করা এক অবিচ্ছেদ্য শক্তি। তবুও সভ্যতার ইতিহাসে তার অবদানকে ছায়ার মতো উপেক্ষা করা হয়েছে, আর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পুরুষের বিজয়গাথাকেই। অথচ সভ্যতার যে বুনিয়াদ—পরিবার, কৃষি, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—সব কিছুর সূচনালগ্নেই নারীর অনন্য অবদান রয়েছে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন মানুষ ছিল যাযাবর, তখন থেকেই নারী ছিল পরিবার কেন্দ্রিক জীবনের মূল চালিকা শক্তি। তারা শিশু প্রতিপালন, অগ্নি সংরক্ষণ, পশু-পাখির যত্ন, ফলমূল সংগ্রহ ও আশ্রয় নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তাদের হাত ধরেই কৃষির সূত্রপাত ঘটে। নারীরা বীজ সংরক্ষণ, মৌসুমি পর্যবেক্ষণ ও চাষাবাদের কৌশল আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই কৃষি বিপ্লবই মানুষের যাযাবর জীবন থেকে বসতিস্থাপন ও সমাজ গঠনের দিকে অগ্রসর হবার পথ তৈরি করে দেয়। এভাবেই নারীর হাতে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়।

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর নিদর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারীর অবস্থান সেখানে পূজনীয় ছিল। মেসোপটেমিয়ার ইন্নানা, মিশরের ইসিস, গ্রীসের আফ্রোদিতি বা ভারতীয় দুর্গা—সবাই মাতৃশক্তির প্রতীক। প্রাচীন ধর্মীয় সমাজব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা ছিল একাধারে পূজ্য এবং সামাজিকভাবে শক্তিশালী। ভারতীয় উপমহাদেশের বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষায় অগ্রসর ছিলেন, বেদ পাঠ করতেন, দার্শনিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ দার্শনিক নারীদের উপস্থিতি সেই সময়ের সমাজচিত্রকে আলোকিত করে তোলে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক রূপ নিতে থাকে। নারীকে গৃহবন্দী করে রাখা, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো শোষণমূলক ব্যবস্থার সূচনা হয়। ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক নিয়মকানুন নারীকে ক্রমশ প্রান্তে ঠেলে দেয়। তবুও নারী থেমে থাকেননি। সাহিত্য, সংগীত, হস্তশিল্প ও ধর্মীয় সাধনায় তারা নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন। মধ্যযুগের সুফি সাধিকা, কবি বা লোকসংস্কৃতির নারীকেন্দ্রিক চরিত্রগুলো সেই অন্ধকার সময়ে নারী-প্রতিষ্ঠার সাহসী নজির হয়ে আছে।

শিল্পবিপ্লবের সময় নারীর শ্রমশক্তি নতুনভাবে চিহ্নিত হয়। তারা কারখানায় কাজ করেন, কাপড় তৈরি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চিকিৎসা এবং সেবাক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন পুরুষেরা যুদ্ধক্ষেত্রে, নারীরাই চালিয়ে গেছেন সমাজের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো। কৃষি, পরিবহন, ডাক বিভাগ থেকে শুরু করে সামরিক লজিস্টিকেও তাদের সক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এই সময়েও নারীর শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি, বরং তা অনেকাংশেই অদৃশ্য থেকে গেছে।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারী অধিকার আন্দোলন বিশ্বজুড়ে জোরদার হয়। নারীশিক্ষা, ভোটাধিকার, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও আইনি নিরাপত্তার জন্য নারীরা সংগঠিত হন। ফ্রান্সের সিমন দ্য বোভোয়া, ইংল্যান্ডের এমিলি প্যাঙ্কহার্স্ট, আমেরিকার রোজা পার্কস, কিংবা বাংলার বেগম রোকেয়া—সবাই এই আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন। বাংলাদেশে নারীশিক্ষা আন্দোলনে রোকেয়ার নেতৃত্ব, পরে সুফিয়া কামাল, সেলিনা হোসেন, শাহীনুর কবিরদের মতো নারীদের অংশগ্রহণ সমাজ সংস্কারের গতিপথকে বেগবান করে।

আজকের দিনে নারীর ভূমিকা শুধু গৃহকেন্দ্রিক নয়। তারা রাজনীতি, প্রশাসন, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, ব্যবসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে বহু নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বৈশ্বিক উন্নয়নের বড় অংশীদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। তা সত্ত্বেও নারী এখনও সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার শিকার। কিন্তু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নারী তার পথ তৈরি করে নিচ্ছেন—নতুন প্রজন্মের জন্য শক্ত ভিত গড়ে তুলছেন।

নারীর এই অবদান কেবল স্মরণ করার জন্য নয়, বরং ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পুনঃস্থাপনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার ইতিহাসে নারীর অনুপস্থিতি প্রকৃত ইতিহাসের অপূর্ণতা। এই শূন্যতা পূরণ করতে হলে নারীকে প্রান্ত নয়, কেন্দ্র থেকে দেখতে হবে। তাদের অবদানকে গ্রহণ করতে হবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূলধারায়, যাতে ভবিষ্যতের সমাজ হয় আরও মানবিক, আরও ন্যায়ভিত্তিক। নারী—তিনি কেবল সভ্যতার সহচর নন, তিনি নিজেই এক অদম্য স্রষ্টা।

সভ্যতার ইতিহাস এক দীর্ঘ অভিযাত্রা, যেখানে পুরুষের অর্জন বারবার উচ্চকণ্ঠে ঘোষিত হলেও, নারীর অবদান প্রায়শই নীরবতা ও উপেক্ষার আড়ালে রয়ে গেছে। অথচ মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে নারীর শ্রম, মেধা, নেতৃত্ব ও ত্যাগ এই ইতিহাসের অনিবার্য অংশ। নারীর উপস্থিতি ছিল না বলার মতো নয়, বরং ছিল সুগভীর—শুধু তা স্বীকৃত হয়নি যথাযথভাবে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন মানুষ গুহাবাসী ছিল, নারী তখনই ছিল সমাজগঠনের মূলে। খনিজ আহরণ ও শিকার পুরুষের দায়িত্ব হলেও, খাদ্যসংগ্রহ, বীজ সংরক্ষণ, পশুপালন, শিশুপালন, অগ্নি সংরক্ষণ, গৃহনির্মাণ এবং তন্তু সংগ্রহের মতো কাজে নারীরা অগ্রণী ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, কৃষিকাজের প্রাথমিক ধাপ—শস্য চিহ্নিতকরণ, রোপণ এবং পর্যবেক্ষণ—নারীর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া থেকেই কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে, যা ছিল সভ্যতার প্রথম সংগঠিত কাঠামো।

মাতৃকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী ছিলেন ‘মাতা’ ও ‘নির্মাতা’—এই দ্বৈত ভূমিকার অধিকারী। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর, সিন্ধু, এবং মায়া সভ্যতার চিত্রলিপি, ভাস্কর্য এবং মৃৎশিল্পে মাতৃরূপ নারীর চিত্রায়ণ বারবার পাওয়া যায়। দেবী ইন্নানা, ইসিস, সিবেল বা দুর্গার উপাসনা এই প্রভাবকেই নির্দেশ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে বৈদিক যুগে নারীর শিক্ষালাভ, দর্শনে অংশগ্রহণ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে নেতৃত্বের স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপালা, লোপামুদ্রা প্রমুখ নারীর বেদে অংশগ্রহণ এটাই প্রমাণ করে যে জ্ঞানের চর্চায় নারী কখনোই পিছিয়ে ছিলেন না।

গ্রীক সভ্যতায় স্যাফো ছিলেন একজন জনপ্রিয় নারী কবি, যাঁর কবিতা প্রেম, সৌন্দর্য ও নারীর অনুভূতিকে তুলে ধরেছিল। চীনা সভ্যতার ইতিহাসে হুয়াংডি'র (Yellow Emperor) চিকিৎসক স্ত্রী লেই জু কৃমিনাশক ও রেশম উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এশিয়ার অন্যান্য সভ্যতায়ও নারীদের চিকিৎসা, শৈল্পিক কাজ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুরোহিত হিসেবে কাজ করার নজির রয়েছে।

তবে ইতিহাসের মধ্যপর্যায়ে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের জাঁতাকলে নারী ক্রমশ পেছনে পড়ে যান। ইসলামোত্তর মধ্যযুগে নারীর অবস্থান বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন হলেও, অধিকাংশ সমাজেই তারা গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। শিক্ষা, সম্পত্তি, মত প্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় তারা বঞ্চিত হন। এর মধ্যেও অনেকেই প্রতিকূলতা ভেদ করে আলো জ্বালিয়েছেন। মধ্যযুগীয় ইউরোপে ক্রিস্টিন দ্য পিজান ছিলেন নারীবাদী চিন্তাধারার প্রথম দিককার লেখক। ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি সাধিকা বিবি ফাতেমা, বাহিনা বাই, এবং কবি মীরা বাঈয়ের মত নারীরা তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যতিক্রমী চিন্তার জন্য পরিচিত।

শিল্পবিপ্লবের সময় নারীর শ্রম নতুন মাত্রা পায়। তাঁরা ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপজুড়ে কারখানায়, খনি ও সুতার কলে কাজ করতে থাকেন। এই সময়েই ‘নারী শ্রমিক’ নামক পরিচয়ের সূচনা ঘটে, কিন্তু তার পরিশ্রমের প্রতিদান ছিল কম মজুরি ও মানবেতর কর্মপরিবেশ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরুষেরা যুদ্ধে গেলে, নারীরাই চালিয়েছেন কৃষি, শিল্প, ডাক, রেল, এবং চিকিৎসা পরিষেবা। যুক্তরাষ্ট্রের "Rosie the Riveter"—একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক—নারী শ্রমিকের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। অথচ যুদ্ধ শেষে নারীদের আবার ঘরে ফেরার আদেশ দেওয়া হয়।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারীবাদী আন্দোলন ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। ‘ফার্স্ট ওয়েভ’ ছিল ভোটাধিকারের জন্য লড়াই, ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ ছিল সামাজিক সমতা ও কর্মক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, আর ‘থার্ড ওয়েভ’ অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক নারীবাদের সূচনা করে, যেখানে জাতি, শ্রেণি, যৌনতা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কথাও গুরুত্ব পায়। ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোন দ্য বোভোয়া, বেটি ফ্রিডান থেকে শুরু করে বাংলার বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সেলিনা হোসেন, শাহীন আক্তার প্রমুখ নারীরা এক নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন। তাঁরা কেবল প্রতিবাদ করেননি, বিকল্প ভাষা ও সংস্কৃতিও নির্মাণ করেছেন।

বর্তমান বিশ্বে নারী নেতৃত্ব নতুন ধারা তৈরি করছে। জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, নিউজিল্যান্ডের জাসিন্ডা আরডার্ন, মালালার মতো তরুণ সংগ্রামী নারীরা বৈশ্বিক রাজনীতির মুখ বদলে দিচ্ছেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে ম্যারি কুরি থেকে শুরু করে ক্যালটেকের ডঃ ফেই ফেই লি, স্পেসএক্সে কাজ করা নারী প্রকৌশলীরা প্রমাণ করেছেন, নারী প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতেও নেতৃত্ব দিতে পারেন।

বিশ্বের মোট কৃষিশ্রমের প্রায় ৪৩ শতাংশই নারীর দ্বারা সম্পাদিত, অথচ তাঁদের ভূমির মালিকানা থাকে মাত্র ১৩ শতাংশের মতো। এই বৈষম্যই প্রমাণ করে, আজও নারীর অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। নারী সাংবাদিকতা, খেলাধুলা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র—প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করছেন। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্যপ্রযুক্তি ও ব্লকচেইন-নির্ভর ডিজিটাল ভবিষ্যতের ভাবনায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

তবু আজও নারীকে পিছু টানতে চায় লিঙ্গবৈষম্য, পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়ন, বেতন বৈষম্য, এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা। এই চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নারী এগিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিদিন তৈরি করছেন নতুন ইতিহাস।

সভ্যতার ইতিহাস লিখতে হলে, শুধুমাত্র রাজা-বাদশা, যুদ্ধ-বিজয়ের কাহিনি নয়, নারীকে নিয়ে আসতে হবে কেন্দ্রবিন্দুতে। নারী ছিলেন, আছেন, থাকবেন—সভ্যতার সত্যিকারের নির্মাতা ও বাহক হিসেবে। অতীতের প্রান্তিক নারীকে কেন্দ্রের আলোয় আনা, কেবল ইতিহাসের দায় নয়—এটি একটি সভ্য জাতির বিবেকের প্রতিফলন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test